টানা দরপতনের মধ্যে থাকা পুঁজিবাজার সংশোধন শেষের আভাস দিল। আগের দিন সূচকের যতটা পতন হয়েছিল, তার সমান উত্থান, এক দিনে প্রায় সাড়ে তিন শ কোম্পানির দর বৃদ্ধির বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মনের দুশ্চিন্তা অনেকটাই লাঘব করেছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দর সংশোধন পঞ্চম সপ্তাহে এসে টানা পতনে রূপ নেয়। ষষ্ঠ সপ্তাহে গত রবি ও সোম- দুই দিনে আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এই দুই দিনে সূচক কমে ১৯০ পয়েন্ট।
উৎকণ্ঠা নিয়েই মঙ্গলবার শুরু হয় লেনদেন। গত ছয় সপ্তাহের প্রায় নিয়মিত দৃশ্য দেখা দেয় বেলা পৌনে ১২টা পর্যন্ত। শুরুর ১০ মিনিটেই ৬৭ পয়েন্ট সূচক বেড়ে গেলেও বেলা পৌনে ১২টায় আগের দিনের চেয়ে সূচক কমে যায় ২৮ পয়েন্ট। অর্থাৎ দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে সে সময় ৯৫ পয়েন্ট হারিয়ে চলছিল লেনদেন।
প্রায় দেড় মাস ধরে এই অবস্থান থেকেই সূচক বড়েছে আরও বেশি। তবে এদিন এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে ১২০ পয়েন্ট বেড়ে শেষ হয় লেনদেন। বেলা পৌনে ১২টা থেকে সূচক বাড়ে ১৪৮ পয়েন্ট।
আগের দিন ধসের আশঙ্কায় থাকা পুঁজিবাজারে এক দিনে ৪১টি কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ল এক দিনে যতটা বাড়া সম্ভব, ততটাই। অর্থাৎ হল্টেড প্রাইসে লেনদেন হয়েছে এসব কোম্পানির শেয়ার দর।
এ ছাড়া হল্ডেট প্রাইসের আশপাশে লেনদেন হয়েছে আরও অন্তত ২০টি কোম্পানির শেয়ার।
সব মিলিয়ে ১০টি কোম্পানির দর বেড়েছে ১০ শতাংশ করে, ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে আরও ২৮টির দর, আরও ২২টির দর বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি, ২৫টির দর বেড়েছে ৭ শতাংশের বেশি, আরও ২০টির দর বেড়েছে ৬ শতাংশের বেশি, আরও ২৯টির দর বেড়েছে ৫ শতাংশের বেশি, আরও ৩৯টির দর বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি।
বিপরীতে যে ২২টি কোম্পানি দর হারিয়েছে, তার মধ্যে কেবল একটি কোম্পানিই ৫ শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর হারানো কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ১.৬৫ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ করা এই ১০টি কোম্পানির কারণে সূচক বেড়েছে ৩৭.৯১ পয়েন্ট
এতদিন সূচকের উত্থান ও পতনে কয়েকটি কোম্পানির অবদান বেশি থাকলেও ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে। সূচক বাড়তে ভূমিকা রাখা ১০টি কোম্পানি সম্মিলিতভাবে বাড়িয়েছে ৩৭.৯১ পয়েন্ট। এর মধ্যে কেবল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, রবি ও আইসিবি- এই তিনটি কোম্পানিই সূচকে যোগ করেছে ২২.২৩ পয়েন্ট।
বাকি সাত কোম্পানি হলো বেক্সিমকো লিমিটেড, তিতাস গ্যাস, জিপিএইচ ইস্পাত, সাইফপাওয়ারটেক, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউনিক হোটেল ও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
অন্যদিকে গ্রামীণফোনের শেয়ার দর ১.৬৫ শতাংশ কমার কারণেই সূচক থেকে হারিয়ে গেছে ১৩.৭১ পয়েন্ট।
স্কয়ার ফার্মা, ইউনাইটেড পাওয়ার, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, বার্জার পেইন্টস, ইবিএল, ম্যারিকো, বিএসআরএম লিমিটেড ও উত্তরা ব্যাংক মিলিয়ে কমিয়েছে আরও ৬.৮৯ পয়েন্ট। সব মিলিয়ে ১০ কোম্পানির অবদান ২০.৬ পয়েন্ট।
মঙ্গলবার যে ২২টি কোম্পানি দর হারিয়েছে, তার মধ্যে এই ১০টি কারণে সূচক পড়েছে ২০.৬০ পয়েন্ট
সূচকে উত্থান হলেও কমেছে লেনদেন। দিন শেষে হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ৩৮৬ কোটি ৯১ লাখ টাকার শেয়ার, যা আগের কর্মদিবসে ছিল ১ হাজার ৪৭০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
১০ খাতের সবাই খুশি
পতনের ভারে যখন বিনিয়োগকারীরা ক্লান্ত তখন একদিনেই হাসির ঝলক দেখালো পুঁজিবাজার। তালিকাভুক্ত ১০ খাতের সব কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে মঙ্গলবার।
এর তলানিতে থাকা নন ব্যাংক আর্থিক খাতের উত্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। বেশিরভাগ সময় দর পতনে থাকা এই খাতের ২২টি কোম্পানির সবগুলোর দর বেড়েছে।
কোনো কোম্পানির শেয়ার বিক্রিতে যখন বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ থাকে তখন সেই কোম্পানির শেয়ার হয় বিক্রেতা শূন্য। তখন তার দর বাড়ে সার্কিট ব্রেকার স্পর্শ করে ১০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। মঙ্গলবার আর্থিক খাতের এমন কোম্পানি ছিল ছয়টি।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে বিডি ফিন্যান্সের ৯.৮৪ শতাংশ। তারপরই আছে ইসলামী ফিন্যান্স, যার শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৫৩ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সের শেয়ার দর বেড়েছে ৯.২২ শতাংশ।
এই খাতে লেনদেন হয়েছে ৯২ কোটি টাকা, যা আগের দিন ছিল ৮৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
বিমা খাতের ৫১ কোম্পানির সবকটি শেয়ারদর বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের, ৯.৯৮ শতাংশ। এছাড়া ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ৭.৫৮ শতাংশ, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ৫.৮৪ শতাংশ, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের দর বেড়েছে ৫.৭৩ শতাংশ বেড়েছে।
এই খাতে লেনদেন হয়েছে মোট ১৫৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
সব কোম্পানির শেয়ার দর বাড়ার তালিকায় আছে সিমেন্ট খাত। এ খাতের লেনদেন হওয়া সাত কোম্পানির সবগুলোর দর বেড়েছে। এছাড়া সার্ভিস ও আবাসন খাতের চারটি কোম্পানির সবগুলোর দর বেড়েছে।
এই খাতে লেনদেন হয়েছে মোট ৪১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি, সিরামিক খাতের পাঁচটি, ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের তিনটি, পাট খাতের তিনটির সবগুলোর শেয়ার দর বেড়েছে।
এছাড়া বস্ত্র খাতের ৫৮টির মধ্যে ৫৭টি, প্রকৌশল খাতের ৪২টির মধ্যে ৪১টি, বিদ্যুৎ-জ্বালানির ২৩টির মধ্যে ২২টি, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ২০টির মধ্যে ১৮টির শেয়ারদর বেড়েছে।
লেনদেনে এগিয়েছে ব্যাংক
উত্থানে বাজার ব্যাংকের লেনদেন আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে। এ খাতের ২২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর বেড়েছে। কমেছে সাতটির।
লেনদেন হয়েছে মোট ১৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৪০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
লেনদেন ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে দুর্বল বা জেড ক্যাটাগরির আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৮.৩২ শতাংশ। শেয়ার দর ৪ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ টাকা ২০ পয়সা।
এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার দরও ১ টাকা ২০ পয়সা বা ৩.৪২ শতাংশ বেড়েছে। এবি ব্যাংকের শেয়ার দর ৪০ পয়সা বা ২.৮৩ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার শেয়ার দর ২.৫৫ শতাংশ, ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে ২.০৭ শতাংশ।
ব্যাংক খাতের দর পতন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে ছিল সিটি ব্যাংক, যার শেয়ার দর কমেছে ৪০ পয়সা বা ১.৪৪ শতাংশ। তারপর আছে ডাচ্-বাংলা, যার শেয়ার দর কমেছে ১ টাকা ১০ পয়সা বা ১.৩৮ শতাংশ।
বিবিধ খাতের বেক্সিমকোতে আগ্রহ কমেছে
শেয়ারে সাড়ে তিন টাকা লভ্যাংশ ঘোষণার পর রোববার বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে যে হুলুস্থল দেখা যায়, তা গত দুই দিনে অনেকটাই কমে এসেছে। রোববার প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা থেকে মঙ্গলবার লেনদেন কমে এসেছে ৮৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকায়।
বেক্সিমকোতে লেনদেন কমায় বিবিধ খাতে লেনদেন কমেছে। এ খাতের লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ১৩টির, কমেছে একটির। দর পতন হওয়া একমাত্র কোম্পানি ছিল বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশ, যার শেয়ার দর কমেছে ৬ টাকা ৫০ পয়সা বা দশমিক ৩৬ শতাংশ।
এ খাতের সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানি ছিল উসমানিয়া গ্লাস, যার শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৭৭ শতাংশ।
সব মিলিয়ে এই খাতে লেনদেন হয়েছে মোট ১০১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ১২১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১২০ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫ দশমিক ৭৮ পয়েন্টে।
শরিয়াভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ১৬ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৮২ দশমিক ৪৬ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ১৭ দশমিক ১০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৬১ দশমিক ৬৪ পয়েন্টে।
দিনশেষে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা।