দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য ‘ইউনিক আইডি’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মৌলিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত সব তথ্য থাকবে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইউনিক আইডি ফরম পূরণে পড়ছেন নানা জটিলতায়। বিশেষ করে শিশুর জন্ম নিবন্ধনের পাশাপাশি মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রশ্ন: কী হবে এই ‘ইউনিক আইডি’ দিয়ে?
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মৌলিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এক জায়গায় রাখার জন্য ইউনিক আইডি তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান এ প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল আলম।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার প্রত্যেক নাগরিককে একটি আইডি দিয়ে চিহ্নিত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিশ্বের ১১টি দেশের সঙ্গে সরকার এ বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর নাম দেয়া হয়েছে সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (সিআরভিএস)।
শামসুল আলম জানান, এর আওতায় দেশের বেসিক স্ট্যাটিসটিকস তৈরি হবে। অফিস অফ রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় বর্তমানে কোনো শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন করছে। আর যারা ১৮ বছরের ওপরে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে। এই দুই স্তরে আইডেন্টিফিকেশন নম্বর আছে। কিন্তু মাঝখানে বাদ পড়ে যাচ্ছে প্রি-প্রাইমারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এদের আইডেন্টিফিকেশনের আওতায় আনার জন্যই ইউনিক আইডি তৈরি করা হচ্ছে।
১৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সব ধরনের সেবা ইউনিক আইডির মাধ্যমে পাবে জানিয়ে তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থীর সব ধরনের সেবা, যেমন বই নেয়া থেকে শুরু করে ফল প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন, বৃত্তি, উপবৃত্তির অর্থ নেয়া অর্থাৎ যত ধরনের নাগরিক সেবা আছে সবই দেয়া হবে এই আইডির মাধ্যমে। আর যখন শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে তখন নির্বাচন কমিশন সচিবালয় তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে এই ইউনিক আইডিই জাতীয় পরিচয়পত্রে রূপান্তর করবে।
শামসুল আলম আরও বলেন, ‘এই ইউনিক আইডির মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের খুঁজে পাব, তারা কোথায় লেখাপড়া করছে, ঝরে পড়ল কি না, অথবা তারা কোন লেভেলে পড়াশোনা করছে, চাকরি পেল কি না ইত্যাদি।’
ইউনিক আইডি চালু হলে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের অপচয়ও বন্ধ হবে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় অনেক সময় আমরা চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ বই ছাপাচ্ছি। এতে অনেক টাকা অপচয় হচ্ছে। যখন ইউনিক আইডি তৈরি হয়ে যাবে, তখন কোনো ডুপ্লিকেট শিক্ষার্থী থাকবে না। কারণ তখন শিক্ষার্থীর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে থাকবে।
ফরমে যেসব তথ্য দিতে হয়
স্ট্যাবলিশমেন্ট অফ ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইইআইএমএস) প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা চার পৃষ্ঠার ফরমে শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ফরমে শিক্ষার্থীর নাম, জন্ম নিবন্ধন নম্বর, জন্মস্থান, জেন্ডার, জাতীয়তা, ধর্ম, অধ্যয়নরত শ্রেণি, রোল নম্বর, বৈবাহিক অবস্থা, প্রতিবন্ধিতা (ডিজ-অ্যাবিলিটি), রক্তের গ্রুপ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কি না, মা-বাবার নামসহ বেশ কিছু তথ্যের ঘর রয়েছে।
বৈবাহিক অবস্থার অপশন হিসেবে অবিবাহিত, বিবাহিত, বিধবা, বিপত্নীক ছাড়াও স্বামী-স্ত্রী পৃথক বসবাস, তালাকপ্রাপ্ত, বিবাহবিচ্ছেদের ঘরও রয়েছে ফরমে।
ইউনিক আইডির তথ্য ভুল হলে তা সংশোধনের কোনো সুযোগ আছে কি না- এমন প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক শামসুল আলম বলেন, ‘শিক্ষার্থী এবং বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে আমরা বেশির ভাগ তথ্য নেব। সেখানে যদি কোনো ভুল থাকে, তাহলে আমাদের কিছুই করার নেই। সংশোধন করতে হলে আগে জন্ম নিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র ঠিক করতে হবে।
‘জন্ম নিবন্ধনে শিক্ষার্থীর নাম, বাবা-মার নাম মিল থাকার বিষয়টি সবাইকে খেয়াল করার অনুরোধ করছি। এই নির্দেশনা মানলে আর কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।’
ইউনিক আইডির ফরমে যেসব তথ্য শিক্ষার্থীরা দিচ্ছেন, তা যেন কোনোভাবে অন্যের হাতে না যায় তা নিশ্চিতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক শামসুল আলম। বলেন, ‘শিক্ষার্থীর তথ্য সুরক্ষায় আমরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি। কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকবে, যেন তথ্য বেহাত না হয়। এর বেশি বলা সম্ভব নয়।’
ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য ‘ইউনিক আইডি’ তৈরি করতে তথ্য সংগ্রহের ফরম। ছবি: নিউজবাংলা
জন্ম নিবন্ধন নিয়ে ভোগান্তি
রাজধানীর মগবাজারে অবস্থিত প্রভাতী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ইউনিক আইডির কাগজপত্র নিয়ে স্কুলে এসেছেন অভিভাবক রাবেয়া সুলতানা। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে জানায়, শিক্ষার্থীর ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধনের সঙ্গে অভিভাবকের ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধনও লাগবে। তা না হলে তার ইউনিক আইডির কাগজ জমা নেয়া হবে না।
একই অভিযোগ করলেন রাজধানীর একাধিক বিদ্যালয়ের অভিভাবকরা। তেমনই একজন স্বপ্না রাণী। তিনি বলেন, ‘বাচ্চার ইউনিক আইডির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন চাওয়া হচ্ছে। আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। তাহলে কেন আবার জন্ম নিবন্ধন লাগবে?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিক আইডির প্রকল্প পরিচালক শামসুল আলম বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে এখন জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তাই আমরা ধরে নিতেই পারি, সব শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধন আছে। যারা স্কুলে ভর্তিই হয়নি, তাদের জন্ম নিবন্ধন নাও থাকতে পারে।
‘সমস্যা হলো জন্ম নিবন্ধনের কোনোটা ম্যানুয়াল, কোনোটা ডিজিটাল। যেসব শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধন ম্যানুয়াল, তাদের ডিজিটাল অর্থাৎ অনলাইনে এন্ট্রি দেয়া জন্ম নিবন্ধন লাগবে। কারণ ইউনিক আইডি দেয়ার অন্যতম শর্ত হলো শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্ম নিবন্ধনের সঙ্গে মিল থাকতে হবে শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধনের।
‘যদি কোনো শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকে তাহলে সে ইউনিক আইডি পাবে না। কারণ আমরা শিক্ষার্থীদের তথ্যগুলো পাঠাব অফিস অফ রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে। তারপর সেখান থেকে যাবে নির্বাচন কমিশনে। এরপর তারা ইউনিক আইডি তৈরি করবে। এটাই সিস্টেম। এ জন্য কোনো শিক্ষার্থীর যদি অনলাইন জন্ম নিবন্ধন না থাকে তাহলে সে ইউনিক আইডি পাবে না।’
অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করতে কিছু শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের নানা ভোগান্তিতে পড়ার কথা স্বীকার করেন শামসুল আলম। বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আসলে আমাদের কিছুই করার নেই। জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে এন্ট্রি দেয়ার জন্য অফিস অফ রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় অনেক আগেই অফিস আদেশ জারি করেছে।’
শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধনে বাবা-মার জন্ম নিবন্ধন কেন প্রয়োজন হয়- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করতে গেলে শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন আগে করে নিতে হবে। এটা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন-২০১৯ অনুযায়ী করা হচ্ছে। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। যদি কেউ তা না করে তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
যেসব শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন নেই, তাদের করণীয় কী- এমন প্রশ্নে শামসুল আলম বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থীর অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ইতিমধ্যে করা আছে, তাদের বাবা-মায়ের শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই শিক্ষার্থী ইউনিক আইডি পাবে। আর যেসব শিক্ষার্থীর অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন এখনও করা হয়নি, তাদের জন্ম নিবন্ধন করতেও বাবা-মায়ের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন লাগবে। এটা আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে।’
শিক্ষার্থীরা ইউনিক আইডি পাবে কবে?
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আশা, আগামী বছরের শুরুতে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ১ কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হবে ইউনিক আইডি।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক পর্যায়ের ইউনিক আইডির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মো. শামসুল আলম বলেন, ‘আগামী ৩০ নভেম্বর শেষ হবে ইউনিক আইডির ফরম পূরণের কার্যক্রম। এরপর ডাটা এন্ট্রি দেয়া হবে। আশা করছি, আগামী বছরের শুরুতেই পর্যায়ক্রমে ১ কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে ইউনিক আইডি তুলে দেয়া সম্ভব হবে। তবে এর আগে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ডিসেম্বরে আমরা কিছু উপজেলায় ইউনিক আইডি বিতরণের পরিকল্পনা করছি।’
জানা গেছে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিক আইডির ডাটা এন্ট্রির সফটওয়্যার তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। আশা করা হচ্ছে, আগামী মাস থেকে ডাটা এন্ট্রি দেয়া শুরু হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে তৈরি হবে ২ কোটির বেশি ইউনিক আইডি।
প্রাথমিকের ইউনিক আইডির প্রকল্প পরিচালক মো. মঞ্জুরুল আলম প্রধান বলেন, ‘প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি তৈরির জন্য বিদ্যালয় পর্যায়ে আগামী মাস থেকে সফটওয়্যারে ডাটা এন্ট্রি শুরু হবে। এ জন্য সফটওয়্যার তৈরির কাজ শেষপর্যায়ে। এরপর পাইলটিং হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থানের ৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি তৈরি করা হবে। এরপর সেটি সফল হলে পুরোদমে শুরু হবে কাজ।’