কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়ার পর সহিংসতা শুরুর জন্য মঈনুদ্দীন আহমেদ বাবু নামের এক ব্যক্তিকে দায়ী করছেন এলাকাবাসী ও মণ্ডপসংশ্লিষ্টরা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক বাহিনীর কর্মকর্তারাও বলছেন, মণ্ডপে কোরআন রাখায় ইকবাল হোসেন প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেও ১৩ অক্টোবর সকালে সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে তৎপর ছিলেন বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে মঈনুদ্দীন আহমেদ বাবু অন্যতম।
বাবু সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর পিএস হিসেবে পরিচিত। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাক্কু ১৩ অক্টোবর সকালে মণ্ডপে হামলার সময় ঘটনাস্থলেই ছিলেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। হামলার সময় পুলিশ বাবুকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সাক্কু তাকে নিজের পিএস পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে নেন। বাবু সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছেন এমন একটি ভিডিও পেয়েছে নিউজবাংলা।
অভিযুক্ত বাবুকে দুদিন ধরে তার এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভীপাড়ায় তার পৈত্রিক বাড়িতে গিয়ে গেটে তিনটি তালা ঝুলতে দেখা গেছে।
প্রতিবেশীরা জানান, বাবু তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রোববার ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এরপর থেকেই তালা ঝুলছে তার বাসায়। বাবুর এক আত্মীয় নিউজবাংলার কাছে দাবি করেন, রোববার সন্ধ্যায় তাকে আটক করে নিয়ে গেছে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার পর চলে ভাঙচুর
মণ্ডপে সহিংসতার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন নিউজবাংলার কাছে অভিযোগ করেন, কোরআন পাওয়া নিয়ে উত্তেজনা শুরুর পর বাবু প্রথম একটি প্রতিমা ভাঙচুর করেন। এরপরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি।
নানুয়ার দিঘির পাড়ের ওই মণ্ডপে চলে ব্যাপক ভাঙচুর, আক্রান্ত হয় নগরীর আরও বেশকিছু পূজামণ্ডপ। পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়।
ইতোমধ্যে মণ্ডপে কোরআন রাখার দায় স্বীকার করেছেন প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন। একই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন মণ্ডপ থেকে ৯৯৯-এ ফোন করা রেজাউল হোসেন ইকরাম, হুমায়ুন কবির ও ফয়সাল হোসেন নামের তিনজন। এদের মধ্যে হুমায়ুন ও ফয়সাল স্থানীয় দারোগাবাড়ী মাজার মসজিদের সহকারী খাদেম। ওই মসজিদ থেকেই কোরআন নিয়ে পাশের পূজামণ্ডপে রাখা হয়ে। এই চারজনকেই সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
মণ্ডপ থেকে ৯৯৯-এ ফোন করা রেজাউল হোসেন ইকরাম
এ ছাড়া ঘটনার দিন সকালে মণ্ডপ থেকে ফেসবুকে লাইভ করা ফয়েজকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা নিউজবাংলাকে বলেন, তারা মনে করছেন, একটি চক্র মণ্ডপে কোরআন রাখতে ইকবালকে এবং সেটি প্রশাসনকে জানাতে ইকরামকে সরাসরি ব্যবহার করেছিল। তবে ১৩ অক্টোবর সহিংসতার পেছনে আরও অনেকের ভূমিকা আছে। তাদের সঙ্গে ইকবাল ও ইকরামকে ব্যবহার করা চক্রের সম্পর্ক আছে কি না, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
কুমিল্লা শহরজুড়ে সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলেও মনে করছেন তদন্তকারীরা।
সহিংসতায় রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের উপস্থিতির তথ্য দিয়েছেন এলাকাবাসী ও পূজামণ্ডপসংশ্লিষ্টরাও।
কুমিল্লা জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালে ওই মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর প্রথমেই পূজা বন্ধ করে দেয়া ও মণ্ডপ সরিয়ে দেয়ার দাবি তোলেন মঈনুদ্দীন আহমেদ বাবু নামের একজন। তার এই দাবিতে সমর্থন জানান উপস্থিত উত্তেজিত জনতা। একপর্যায়ে বাবু নিজে পূজায় ব্যবহৃত একটি ডাব ছুড়ে মণ্ডপের একটি প্রতিমার মাথা ভেঙে ফেলেন। এরপরেই শুরু হয় সহিংসতা।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাস টিটুও নিউজবাংলাকে একই তথ্য দেন।
স্থানীয় বেশ কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, উত্তেজনা শুরুর পর ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন বিএনপি থেকে সিটি মেয়র নির্বাচিত মনিরুল হক সাক্কু। অভিযুক্ত বাবু তার পিএস হিসেবে পরিচিত। হামলা শুরুর পর পুলিশ বাবুকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলেও সাক্কু তাকে ছাড়িয়ে নেন।
নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভীপাড়ায় বাবুর পৈত্রিক বাড়িতে ঝুলছে তালা
এলাকাবাসী জানান, নানুয়ার দিঘির পাড়েই মেয়র সাক্কুর বাসা। তিনি ঘটনাস্থলে এলেও বিএনপি সমর্থকেরা দিঘির দুই প্রান্তে জড়ো হয়ে উত্তেজনা ছড়াতে থাকেন। এ সময় যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ মেয়র সাক্কুকে তার সমর্থকদের শান্ত করার অনুরোধ জানান। এরপর সাক্কু তার একজন কর্মীকে ফোন করে বিক্ষুব্ধদের শান্ত করতে বলেছিলেন, তবে মাঠে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।
মেয়র সাক্কুর নির্দেশের পরও দলের কর্মীরা কেন উত্তেজনা কমাতে তৎপর হলেন না- জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কর্মী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা আমরা কেন সামাল দেব, সরকারি দলের লোকেরা কী করে? তাছাড়া এসব ঝামেলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তো পুলিশের।’
বাবুকে নিয়ে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর সঙ্গে সরাসরি এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। তবে তাকে পাওয়া যায়নি, জানা গেছে তিনি এখন কুমিল্লায় নেই। সাক্কুর অনুসারীরা জানান, তিনি ওমরাহ পালনে সৌদি আরব গেছেন।
কুমিল্লা সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু
মণ্ডপে সহিংসতা ঠেকাতে আওয়ামী লীগ জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেও অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় বেশ কয়েকজন নিউজবাংলাকে জানান, সেদিন সকালে মণ্ডপ এলাকায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত ও মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ ছাড়া আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল আর কোনো নেতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সকালে ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব কর্মীদের ফোন করেছি। অনেক কর্মী রাত করে ঘুমায় তাই তাদের কাউকে কাউকে ফোনে পাওয়া যায়নি। যারা ফোন ধরেছে তারা সবাই ছুটে এসেছিল, তাদের নিয়েই সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন বাহারের নির্দেশে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে সাহায্য করেছি। তখন এমপি সাহেব ওমরায় থেকেও পুরো সময় আমাদের সঙ্গে টেলিফোনে যুক্ত ছিলেন।’
কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে রয়েছে দুটি পক্ষ। স্থানীয়রা জানান, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও কুমিল্লা মহানগর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহাউদ্দীন বাহার এবং সংরক্ষিত ১০ নং মহিলা আসনের সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমার মধ্যে দলীয় কোন্দল বহু পুরোনো। ঘটনার দিন সীমা সমর্থক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মাঠে দেখা যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মণ্ডপে কোরআন রাখার মামলায় রিমান্ডে থাকা ইকরামকে বিভিন্ন সময়ে বিএনপির মিটিং-মিছিলে দেখা যেত। ইকরাম তার নিজ ওয়ার্ডের বিতর্কিত কাউন্সিলর সাইফুল বিন জলিলের একনিষ্ঠ কর্মী। ইকরামের বাসা আবার বাবুর বাসার পাশের গলিতে।
সাইফুল বিন জলিল একসময় মেয়র সাক্কুর অনুসারী হিসেবে বিএনপির রাজনীতি করলেও এক বছর আগে তিনি সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমার অনুসারী হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সম্প্রতি সাইফুলের কাউন্সিলর পদ স্থগিত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
ইকরামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ নিয়ে বক্তব্য জানতে সাইফুলকে একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা
অন্যদিকে, সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি যখন কাউন্সিলর ছিলাম তখন সাইফুলও একজন কাউন্সিলর হিসেবে আমার কলিগ ছিল। আমি তাকে আমাদের কর্মী হিসেবেই জানি। সে আগে বিএনপি করত কি না সেটা মেয়র সাক্কু সাহেবের উত্তর দেয়া উচিত।’
সহিংসতা ঠেকাতে নিজের অনুসারীদের মাঠে না থাকার অভিযোগের বিষয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সেদিন ঢাকায় ছিলাম। ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে প্রশাসনের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না তার খোঁজ রেখেছি। আমাদের কিছু কর্মীও সেখানে গিয়েছিল।’
এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন বাহার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা, আমি দেশে থাকলে এমনটা হতো না। তারপরেও প্রশাসনের সহায়তায় খুব শর্ট টাইমের মধ্যে আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। এখন কোনো সমস্যা নেই।’
সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন বাহার
বাবুর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে মেয়রকে ফোন করে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছি, সেও গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। সেখানে তার লোক যদি ঝামেলা করে, এমনকি আমাদের কোনো লোকও যদি কোনোভাবে জড়িত থাকে তাহলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। এ ঘটনায় কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’
কাউন্সিলর সাইফুলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের রাজনীতির জন্য একটা লজ্জা। একজন মহিলা এমপি এই বাজে কাজটা করেছেন। আমাদের আওয়ামী লীগে যেকোনো পেশার লোক যোগ দিতে পারে, কিন্তু তার মানে এই না যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিতর্কিত কাউকে আওয়ামী লীগে জায়গা দেয়া যায়। তাছাড়া আমি হলাম কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, কাউকে আওয়ামী লীগে ঢোকাতে হলে আমার কমিটির মধ্য দিয়ে আসতে হবে। উনি কীভাবে বিতর্কিত একজনকে আওয়ামী লীগের ব্যানারে সমর্থন করতে পারেন তা আমার মাথায় আসে না।’