জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের কারণ দর্শানোর চিঠির জবাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু ও শহীদদের সংখ্যা নিয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের আপত্তিকর মন্তব্যে ক্ষেপেছেন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গাজীপুর আওয়ামী লীগ। তবে এখনও পাল্টা-পাল্টি অবস্থান আছে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ।
গত ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ। এতে তাকে ১৫ দিন সময় দেয়া হয়। বেঁধে দেয়া সময়সীমার আগেই মেয়র জাহাঙ্গীর তার দলের নোটিশের জবাব দিয়েছেন। শোকজের জবাব তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দিয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ১৮ অক্টোবর নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শোকজের জবাব অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি।’
গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় জাহাঙ্গীরের বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় অনেক নেতাই তার শোকজের জবাবে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। অনেকে তার নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
আগামী ১৯ নভেম্বর পরবর্তী কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি সমাধান হতে যাচ্ছে বলে জানান দলের নীতিনির্ধারকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দল যে কারণে তাকে (মেয়র জাহাঙ্গীর) শোকজ করেছে তার উত্তর তিনি দিয়েছেন। নেত্রী সেটা পেয়েছেন। শোকজের জবাবে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ বিষয়টি নিয়ে দলের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নেত্রী এ বিষয়ে অবগত। আগামী ১৯ তারিখ তার বিষয়ে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মন্তব্যে জাহাঙ্গীরের বিষয়ে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আরও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে জানান দলের সভপতিমণ্ডলীর ওই সদস্য।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গত শনিবার জানান, ‘দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক আলোচনার পাশাপাশি দলীয় আদর্শ এবং শৃঙ্খলাবিরোধী বক্তব্যের জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে প্রদত্ত শোকজ নোটিশের ওপর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।’
সম্প্রতি প্রকাশিত রেকর্ডটিতে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধিকার আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গাজীপুর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খানকে নিয়েও আপত্তিকর বক্তব্য আছে সেই ভিডিওতে। বিষয়টি পছন্দ হয়নি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় অংশের। নানাভাবে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখান তারা।
জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়টি নিয়ে গাজীপুরের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের বিভাজন এখনও স্পষ্ট। তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর নেতা-কর্মীরা উত্তপ্ত থেকে প্রশমিত হয়েছিল মাত্র। তবে গত শুক্রবার মনোনয়ন বোর্ডে এ বিষয়ে বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য চালাচ্ছেন তারা।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনও পাল্টাপাল্টি অবস্থানেই রয়েছে সবকিছু। কেন্দ্র থেকে যে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা মেনে নেব। আসলে আমরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য।’
এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি এখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে। আমরা সেই সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি।’
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৫৭ ধারায় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার বিষয়ে বলা আছে। সেখানে বলা আছে, যেকোনো সদস্য আওয়ামী লীগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নিয়মাবলি, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে অংশ নিলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ তার বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে।
টঙ্গী পৌরসভার একাধিকবারের মেয়র আজমত উল্লাহ গাজীপুর আওয়ামী লীগের ভীষণ জনপ্রিয় নেতা। ২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনে তার পরাজয় ছিল অপ্রত্যাশিত। সে সময় তিনি জাহাঙ্গীর অনুসারীদের সমর্থন পাননি বলে প্রচার আছে। এমনও প্রচার আছে যে, জাহাঙ্গীর সমর্থকরা তার বিপক্ষে কাজ করেছে। এই বিষয়টি আট বছর পর আবার সামনে আসছে।
২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনের আগেই তুমুল আলোচনায় ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে সে সময় দলের বড় পরাজয়ের পেছনে যেসব কারণ উঠে এসেছিল, তার মধ্যে ভোট থেকে সরে গেলেও জাহাঙ্গীর অনুসারীদের তৎপর না থাকা ছিল একটি। পরে ২০১৮ সালে যখন জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ তখন তিনি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে সহজেই পরাজিত করেন।
ভাইরাল দুই ভিডিওতে বেকায়দায় জাহাঙ্গীর
২২ সেপ্টেম্বর ৪ মিনিটের ও ২৫ সেপ্টেম্বর ৫০ মিনিটের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
এতে দেখা যায়, ঘরোয়া আলোচনায় মেয়র তার ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে কথা বলছেন। সেখানে তার কথায় স্পর্শকাতর অনেক বিষয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য উঠে আসে।
ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, মেয়র মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, হেফাজতের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে তার সখ্য ও রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করছেন মেয়র জাহাঙ্গীর।
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তুলে একাধিকবার সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন।