উচ্চ ফলনশীল, স্বল্প মেয়াদি, খরাসহিষ্ণু, আলোক সংবেদনশীল ও উন্নত গুণাগুণের বিনা ধান-১৭ আবাদে কৃষি খাতে বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ জাত আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। এখন সারা দেশে জাতটি ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানান, উদ্ভাবিত এ জাতের ধানগাছ খাটো ও শক্ত বলে হেলে পড়ে না। পূর্ণবয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৬ থেকে ৯৮ সেন্টিমিটার। পাতা গাঢ় সবুজ ও খাড়া। ধান আগাম পেকে যাওয়ায় কাটার পর জমিতে সহজেই আলু, গম বা রবিশস্য চাষ করা যায়।
বিনা ধান-১৭ উজ্জ্বল রঙের। ধান ও চাল লম্বা এবং চিকন, খেতে সুস্বাদু। এ কারণে বাজারমূল্য বেশি ও বিদেশে রপ্তানির উপযোগী। চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৪.৬ শতাংশ এবং হেক্টরপ্রতি ৬.৮ টন থেকে সর্বোচ্চ আট টন পর্যন্ত ফলন হয়।
এ ধানের চাল রান্নার পর ভাত ঝরঝরে হয় এবং দীর্ঘক্ষণ রাখলেও নষ্ট হয় না। ধানের এই জাতটি পাতা পোড়া, খোল পচা ও কাণ্ড পচা ইত্যাদি রোগ তুলনামূলকভাবে বেশি প্রতিরোধ করতে পারে। এ ছাড়া প্রায় সব ধরনের পোকার আক্রমণ, বিশেষ করে বাদামি গাছফড়িং, গলমাছি ও পামরি পোকার আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক বেশি।
বিজ্ঞানীরা জানান, ধান চাষ বৃদ্ধির কারণে তেল ও ডালজাতীয় শস্যের জমি কমে যাচ্ছে। বিনা ধান-১৭ উচ্চ ফলনশীল এবং এর জীবনকাল তুলনামূলকভাবে অনেক কম বলে শস্য নিবিড়তা বাড়াতে খুবই কার্যকর। আগাম পাকা জাত হিসেবে এটি চাষ করে সঠিক সময়ে তেল ও ডাল ফসল চাষ সম্ভব।
লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের সব রোপা আমন অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা এবং রাজশাহীসহ ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ও পার্বত্য অঞ্চলে জাতটির বেশি ফলন পাওয়া যায়।
বিনা ধান-১৭ জাতের ধানটি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। সহযোগী গবেষক হিসেবে ছিলেন উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামছুন্নাহার বেগম।
ড. শামছুন্নাহার বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ জাতের ধানটি উদ্ভাবনে পাঁচ বছর গবেষণা করা হয়েছে। বিনা ধান-১৭-এর কৌলিক সারি নম্বর SAGC-7, যা ইরি-বিনার সহযোগিতায় ইরি-ফিলিপাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়। সারি C418 (ZHONG413)-এর সঙ্গে SH109/(ZHONG413)2 সংকরায়ন করে পরে খরাসহিষ্ণু (ZHONG413)2-এর সঙ্গে পশ্চাৎ সংকরায়ন ও জিন পিরামিডিংয়ের মাধ্যমে লাইনটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।’
তিনি জানান, এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমন মৌসুমে ফলন পরীক্ষার মাধ্যমে জাত হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি জাত হিসেবে সারা দেশে আমন মৌসুমে চাষের জন্য বিনা ধান-১৭ নামে অনুমোদন দেয়।
ড. শামছুন্নাহার বলেন, ‘এ জাতে ইউরিয়া সার এক-তৃতীয়াংশ কম প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া ৫০ শতাংশ সেচের অর্থ সাশ্রয় হয়। ধানটি চিকন ও ভাত খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ভালো দাম পান কৃষক। এ ছাড়া অ-মৌসুমে ধান কাটায় গোখাদ্য হিসেবে খড়ের সরবরাহ বাড়বে, এতে ভালো দামে খড় বিক্রিও করা যাবে।’
জাতটির চাষাবাদ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাঁচ শতাংশ বীজতলায় ১০ কেজি বীজ ফেলতে হবে। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ (আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজতলা তৈরি করে ২০ থেকে ২৫ দিনের চারা রোপণ করলে ভালো ফসল পাওয়া যায়। তবে, জুলাইয়ের শেষ (শ্রাবণের দ্বিতীয়) সপ্তাহ পর্যন্তও বীজতলা করা যায়।
‘এ ছাড়া জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহ (শ্রাবণ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ) পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। বেশি বয়সের চারা লাগালে ফলন কমে যায়, তাই চার সপ্তাহের বেশি বয়সের চারা রোপণ করা কোনো অবস্থাতেই উচিত নয়।’
ড. শামছুন্নাহার জানান, বীজতলায় চারা করার পর লাইন করে চারা রোপণ করলে ফলন বেশি হয়। এ জন্য দুই থেকে তিনটি সুস্থ-সবল চারা একত্রে এক গুছিতে রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার (আট ইঞ্চি) এবং সারিতে গুছির দূরত্ব ১৫ সেন্টিমিটার (ছয় ইঞ্চি) থাকা ভালো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলায় গত বছর ২৩১ হেক্টর জমিতে বিনা ধান-১৭ আবাদ হয়েছে। আগাম ধান হওয়ায় খুশি কৃষক। এ বছর ২৭০ হেক্টর জমিতে এ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। আগামী বছর আরও বেশি চাষ হবে।’
বিনা ধান-১৭ জাতের ধানের উদ্ভাবক বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ জাতটি সম্পর্কে ইতোমধ্যে কৃষকদের অবগত করা হয়েছে। নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ময়মনসিংহ বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি আবাদ হয়েছে। অল্প খরচে বেশি উৎপাদনসহ চাল বিক্রি করে লাভবান হওয়ায় আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের।’
তিনি বলেন, “এ ধানগাছের প্রতিটি শিষে পুষ্ট দানার সংখ্যা ২৫০ থেকে ২৭০টি। প্রচলিত জাতের তুলনায় ইউরিয়া সার ৩০ শতাংশ কম ও জমিতে ৪০ শতাংশ পানি কম লাগে। এ কারণে ‘গ্রিন সুপার রাইস’ হিসেবেও জাতটির নামকরণ হয়েছে।”
মহাপরিচালক বলেন, ‘চলতি মাসে বিভিন্ন জাতের ধানে এখনও শিষ বের হয়নি। এগুলো পরিপক্ব হতে আরও দেড় মাস লেগে যাবে। অথচ অন্য জাতের সঙ্গে একই সময়ে লাগানো বিনা ধান-১৭ জাতের ধান কাটা শেষ হয়েছে। কিছু জমিতে ধান থাকলেও সেগুলোও সম্পূর্ণ পেকে গেছে। এখন কৃষক ধান কাটতে ও মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত। আগাম ধান কাটা শেষ হওয়ায় একই জমিতে এরপর আলু, গম বা রবিশস্য চাষ করা যাবে।’