দুই দিন আগেই পরনে ছিল রঙিন শাড়ি, মাথায় সিঁদুর আর হাতে শাঁখা। আর এখন সব রং মুছে দিয়ে সাদা শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন রুপা দাশ। স্বামীকে চিতার আগুনে পোড়ানোর আগে তার পায়ের বুড়ো আঙুলে মুছে দেয়া হয়েছে রুপার সিঁথির সিঁদুর।
কুমিল্লায় গত ১৩ অক্টোবর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় গুরুতর আহত হন দিলীপ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শুক্রবার ভোরে তার মৃত্যু হয়।
দিলীপের মরদেহ শুক্রবার সন্ধ্যায় টিক্কার চর শ্মশানে দাহ করার আগে মুছে দেয়া হয় রুপার মাথার সিঁদুর, ভাঙা হয় হাতের শাঁখা। রঙিন শাড়ির পরিবর্তে তিনি এখন পরছেন বিধবার সাদা কাপড়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সহিংসতার দিন সকালে বাসায় নাশতা সেরে কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর রাজ রাজেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিলেন দিলীপ দাশ।
নানুয়ার দিঘির পাড়ের একটি মণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর তখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে নগরীজুড়ে। রাজ রাজেশ্বরী কালীমন্দিরেও চলে হামলা।
সংঘাত দেখে বাসায় ফিরতে চেয়েছিলেন দিলীপ। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মন্দিদের গেটের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় হামলার শিকার হন, লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।
রাজ রাজেশ্বরী কালীমন্দিরের পুরোহিত দুলাল চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে জানান, ১৩ অক্টোবর ওই সহিংসতার সময় মন্দির থেকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন দিলীপ। তবে বাইরে প্রচণ্ড গন্ডগোল শুরু হওয়ায় তিনি মন্দিরের গেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একপর্যায়ে মন্দিরের ভেতরে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে হামলাকারীরা। এ সময় গুরুতর আহত হলে পূজারীরা আহত দিলীপকে গামছা দিয়ে মাথা বেঁধে বসিয়ে রাখেন। পরে তাকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দিলীপের স্ত্রী রুপা দাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই দিন দেড়টায় কুমিল্লা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ফোন পাই। এ সময় আমাদের বাসার সামনে পুলিশ ও হামলাকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছিল। পুলিশ আমাদের বাইরে যেতে নিষেধ করে। এর মধ্যেই আমি এক আত্মীয়কে নিয়ে হাসপাতালে যাই।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে আমার স্বামীর অবস্থার অবনতি হয়। পরে বেলা ২টার দিকে চিকিৎসক তাকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। আমরা তাকে সেখানে নিলে চিকিৎসক সিটিস্ক্যান করাতে বলেন।’
রুপা দাশ অভিযোগ করে বলেন, ‘এ সময় হাসপাতালে বিদ্যুৎ না থাকায় সিটিস্ক্যান করাতে আমাদের অন্তত আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। পরে রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ১৫ তারিখে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে তার মৃত্যু হয়।’
পরিবারের কাছে দিলীপ দাশ এখন কেবলই ছবিদিলীপ দাশ ধোপার কাজ করে সংসার চালাতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে প্রিয়া রানী দাশ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। আর ছেলে রাহুল দাশ ঢাকায় লেখাপড়া করেন।
দিলীপের মেয়ে প্রিয়া বলেন, ‘বাবার মাথায় যে আঘাত দেখেছি তাতে স্পষ্ট যে হামলাকারীরা আমার বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। তার মাথার খুলি ভেঙে যায়। রক্তক্ষরণ ও তাৎক্ষণিক সঠিক চিকিৎসার অভাবে আমার বাবা মারা গেছেন।’
প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি এখন দিশেহারা। দিলীপ দাশের মেয়ে প্রিয়া জানান, তার বাবার মৃত্যুর পর তেমন কেউ খোঁজখবর নিতে আসেনি।
প্রিয়া নিউজবাংলাকে জানান, তিনি দৃষ্টিপাত নাট্যদলের সদস্য। তার বাবা হামলায় আহত হওয়ার পর ওই নাট্য সংগঠন চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। এ ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেনি।
ছেলে মেয়েকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন দিলীপের স্ত্রীদিলীপের স্ত্রী জানান, তাদের পরিবারের মূল নির্ভরশীলতা ছিল স্বামীর আয়ের ওপর। পাশাপাশি একটি ছোট দোকান ভাড়া দিয়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যায়।
রুপা দাশ বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর আমরা বড় সমস্যায় পড়েছি। দোকান ভাড়ার মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় কীভাবে সংসার চলবে, দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাব তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
দুর্গাপূজায় সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের ওই মণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার পর ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা।
ওই মণ্ডপের পাশাপাশি আক্রান্ত হয় নগরীর আরও বেশ কিছু পূজামণ্ডপ। পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।