চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি এহতেশামুল হক ভোলা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার জবানবন্দিতে মিতু হত্যায় বাবুল আকতারের সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে।
মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতের বিচারক শফিউদ্দিনের আদালতে শনিবার বিকাল ৪টায় ভোলাকে তোলা হয়। এরপর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাকে বের করা হয়।
আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহীন নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, জবানবন্দি শেষে বিচারক ভোলাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।
জবানবন্দি দেয়ার সময় আদালতে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জবানবন্দিতে ভোলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এই মামলার অন্য পলাতক আসামিরা কোথায় আছেন সেই বিষয়েও তথ্য মিলেছে। পাশাপাশি হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের ব্যাপারে ভালো তথ্য পাওয়া গেছে। অস্ত্র সরবরাহের কথা ভোলা স্বীকার করেছেন।’
ভোলা জানান, ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার থাকাকালে বাবুলের সোর্স ছিলেন কামরুল শিকদার ওরফে মুছা। মুছার সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল ভোলার। তিনিই ভোলাকে বাবুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর থেকে ভোলা বাবুলকে বিভিন্ন তথ্য দিতেন।
একপর্যায়ে ভোলার দেয়া তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা এলাকায় গুলি করতে যাওয়া এক আসামিকে ধরে বাবুল বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এরপর থেকে তাদের সখ্য আরও বাড়ে।
ভোলা বলেন, ‘২০১৬ সালের মে মাসে মুছা আমাকে জানায়, বাবুল পারিবারিক সমস্যায় আছেন। তার স্ত্রীকে খুন করতে হবে। এ জন্য আমি যেন অস্ত্র সংগ্রহ করে দেই। আমি অস্ত্র সংগ্রহ করে মুছাকে দেই। এরপর মিতু হত্যার দিন ২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে মুছা আমাকে বারবার ফোন দিতে থাকে। আমি ফোন ধরিনি।
‘সকাল ১১টার দিকে ব্যবসায়িক কাজে খাতুনগঞ্জের শাহজালাল ব্যাংকে গিয়ে টেলিভিশনে দেখি, বাবুল আকতারের স্ত্রী মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। তখন মুছাকে ফোন দেই কিন্তু তার ফোন বন্ধ ছিল। বিকেলে আমার অফিসে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে মুছা। সে আমাকে বলে, তার কোনো উপায় ছিল না। সে যদি মিতু ভাবিকে না মারত, তাহলে বাবুল আক্তার তাকে ক্রসফায়ারে দিত।’
ভোলা বলেন, “তখন আমি মুছাকে বলি, ‘এ কাজটা না করলে বাবুল স্যার হয়ত একবার ক্রসফায়ারে দিত, এখন পুলিশ তো তোকে (মুছাকে) দশবার মারবে।’”
এরপর মুছা ভোলার অফিসে একটি কাপড়ের ব্যাগ রেখে চলে যান। ওইদিন রাতে মুছার ঘরের কেয়ারটেকার মনির এসে ব্যাগটি নিয়ে যায়। পরে ভোলার তথ্যে ডিবি পুলিশ মনিরের বাসা থেকে ব্যাগটি উদ্ধার করে। সেখানে একটি অস্ত্র ছিল যা মিতু হত্যায় ব্যবহার হয়েছিল।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চট্টগ্রাম নগরীর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা জানান, যশোরের বেনাপোল থেকে শুক্রবার ভোরে ভোলাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়।
মিতু হত্যা মামলায় হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করলে ১৫ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ ভোলাকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দেয়।
জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তাকে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফখরুদ্দিন চৌধুরী ১৪ অক্টোবর বলেন, ‘ভোলা আজ আত্মসমর্পণ না করে সময়ের আবেদন করেন। আমরা এর বিরোধিতা করি। ভোলা হাইকোর্টের নির্দেশনা পালন না করায় আদালত সময়ের আবেদন নাকচ করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।’
মাহমুদা খানম মিতু
বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে স্ত্রী মিতুকে হত্যার অভিযোগে বাবুলের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১২ মে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করা হয়। মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের করা সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ওই দিনই বাবুলকে আদালতে তোলা হলে বিচারক পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
রিমান্ড শেষ হওয়ার পর থেকে কারাগারে আছেন বাবুল।
২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বের হওয়ার পর চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় মিতুকে।
ঘটনার পর তৎকালীন এসপি বাবুল আকতার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করেন, তার জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
তবে বাবুলের শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন ও শাশুড়ি সাহেদা মোশাররফ এই হত্যার জন্য বাবুলকে দায়ী করে আসছিলেন।
শুরুতে চট্টগ্রাম পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) মামলাটির তদন্ত করে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালত মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দেয়।