শারদীয় দুর্গাপূজা ও পূজার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে চলা সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষতিপূরণ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের পূর্ণ নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় ৮ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ।
একই সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় শ্যামাপূজায় দীপাবলি উৎসব বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। তবে সীমিত পরিসরে শ্যামা পূজা করা হবে বলে জানানো হয়।
রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে শুক্রবার সকালে ‘শারদীয় দুর্গাপূজার সময় সারা দেশের পূজামণ্ডপে সাম্প্রদায়িক শক্তির হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার বিষয়ে’ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি এসব কথা বলেন।
পূজা উদ্যাপন পরিষদের ৮ দাবি
১. ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির, বাড়িঘর সরকারি খরচে পুনর্নির্মাণ করে দিতে হবে। গৃহহীনদের দ্রুত পুনর্বাসন করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২. নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে প্রকৃত দোষীদের বিচারের পদক্ষেপ নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ক্ষেত্রেই নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা যাবে না।
৪. সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং তদন্ত কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে, তা প্রতিবিধানে সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য ও পূর্ণাঙ্গ শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।
৬. ২০০১ সালের সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর ওপর তদন্ত-সম্পর্কিত সাহাবউদ্দিন কমিশন রিপোর্টের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষিত সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় নৃগোষ্ঠীর বিষয়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি, সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত স্বত্বাধিকারীর কাছে ফেরত দেয়া, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যমূলক আইনের অবসানসহ ইশতেহারের ৩ (২৯) অনুচ্ছেদে ঘোষিত অন্যান্য প্রতিশ্রুতিও সরকারের এই মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. সংবিধানে বিরাজমান অসংগতি দূর করে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ১৯৭২ সালের সংবিধান পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
পূজা উদ্যাপন পরিষদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক
কুমিল্লার নানুয়া দিঘির পাড়ের দুর্গাপূজার মণ্ডপে হনুমান মূর্তির কোলের ওপর রাখা পবিত্র কোরআন শরিফটি সরিয়ে নেয়ার পর কেন ভিডিও করার সুযোগ দেয়া হলো, কেন সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এবং কেন ওই দিন রাতে বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।
সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জি বলেন, কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের মণ্ডপটি অস্থায়ী।
তিনি বলেন, ‘ওই দিন দিবাগত রাত তিনটা থেকে চারটার দিকে কিছু সময়ের জন্য মণ্ডপ এলাকা বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কী কারণে কিছু সময়ের জন্য মণ্ডপ বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সে বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে কি?
‘থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হনুমান মূর্তির কোলের ওপর রাখা পবিত্র কোরআন শরিফটি সরিয়ে নেয়ার পর কেন ভিডিও করার সুযোগ দিলেন এবং কেন সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তা সবার কাছে বিরাট প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
নির্মল চ্যাটার্জি আরও বলেন, ‘২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিগত কয়েক বছর ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বা হচ্ছে। কোনো কোনো হামলার ক্ষেত্রে সর্বদলীয় অংশগ্রহণের ঘটনা ঘটেছে। দেশে আইন আছে। প্রকৃতই কোনো ব্যক্তি, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, এ ধরনের ন্যক্কারজনক অপরাধ করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে না দিয়ে একজনের কথিত অপরাধে একটি সম্প্রদায়ের ওপর হামলা প্রকারান্তরে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশান্তরি করার নীলনকশার অংশ বলে সাধারণ হিন্দুরা মনে করে।’
বিচারহীনতা বা বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি দুষ্কৃতকারীদের উৎসাহিত করছে এবং প্রায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মূল ঘটনাগুলো ঘটছে বলেও মনে করে পূজা উদ্যাপন পরিষদ।
লিখিত বক্তব্যে নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, ‘কোনো একটি ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক দোষারোপের কারণে প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, যা দেশের আইনশৃঙ্খলা ও পারস্পরিক আস্থার জন্য সুখকর নয়।’
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, কিন্তু সেগুলো রক্ষা করা হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক দোষারোপ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে দিয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ, পূজা উদ্যাপন পরিষদের উপদেষ্টা জয়ন্ত সেন, মহানগর পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি শৈলেন মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক কিশোর মণ্ডল প্রমুখ।