দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যেসব ব্যবস্থা দরকার, তা নেয়া হচ্ছে না। তা ছাড়া দুর্ঘটনার জন্য পরিবহন শ্রমিকদের এককভাবে দায়ী ভাবার প্রবণতা রয়েছে। অথচ দুর্ঘটনার জন্য দুর্বল পরিকল্পনাও সমান দায়ী।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না।
এমন বাস্তবতায় শুক্রবার পালন করা হচ্ছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি।’
এ উপলক্ষে নিরাপদ সড়ক বা সড়কে নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে, সে বিষয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক শামসুল হক।
প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে মহাসড়কে গাড়িচালকদের বিশ্রাম ও টানা গাড়ি চালানোর সর্বোচ্চ সময় নির্ধারণের কথা বললেও সেটির কোনো বাস্তবায়ন দেখছেন না এ পরিবহন বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘পুরো বিশ্বে হাইওয়েতে (মহাসড়ক) চার ঘণ্টার বেশি টানা গাড়ি চালানো নিষেধ। এতে চালকের অবসাদ চলে আসতে পারে। তার যে মনোযোগ দরকার হয় চলার জন্য, তাতে ঘাটতি পড়তে পারে।
‘চার ঘণ্টা পর ভিন্ন একজন চালক থাকবে। এটা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে আছে। আর পশ্চিমা দেশে তো আছেই। বাণিজ্যিক গাড়ি বিরতিহীনভাবে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি চালাতে দেয়া যাবে না।’
এ অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এই দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তবে কাজ হয়নি। এর মানে কী? পুলিশ এখানে কাজ করছে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কাজ করছে না। যারা কর্তৃপক্ষ, তারা কাজ করছে না। তার মানে চালকের দায়, পুলিশের দায়, ইঞ্জিনিয়ারের দায়।’
ট্রাফিক ও ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে
সড়কের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হলেও সেটি পরিকল্পিতভাবে নেয়া হয়নি বলে মনে করেন শামসুল হক।
তিনি বলেন, ‘সড়ক ব্যবস্থাপনা ও রোড ট্রাফিক সিস্টেম সুশৃঙ্খল হতে পারত, তবে তা হয়নি। আমি যদি ঢাকার কথাই বলি, ঢাকায় গণপরিবহনের যে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি, সেটা যদি আমরা করে ফেলতে পারতাম, তবে ঠিক হয়ে যেত।’
এ অধ্যাপক বলেন, ‘কিছু কাজ করতে দরদ লাগবে। এই যে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি, এটাতে তো পয়সা লাগে না। এটা রেগুলেশন। এটা এনফোর্সমেন্ট। এখানে তো পয়সা নাই বলতে পারবে না। এখানেই আমাদের অবহেলা।’
ঢাকার রাস্তায় ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস বা ‘এক রুটে এক বাস কোম্পানি’ পদ্ধতি চালু হলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি হলে বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে যাবে। হুড়োহুড়ি করতে গিয়েই ঢাকায় অনেক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করা হয়।
মহাসড়কের পরিকল্পনা
দেশের মহাসড়কগুলোতে বিশৃঙ্খলা রয়েছে আর সেটির জন্য ছোট পরিবহন ও গাড়ির ফিটনেসকে দায়ী করেন শামসুল হক।
তিনি বলেন, ‘আমি যদি হাইওয়েতে ফিট গাড়ি না চালাই, অবৈধ গাড়ি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তবে দুর্ঘটনা ঘটবে।’
এ ক্ষেত্রে তিনি হাইকোর্ট ও সরকারের দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সব জায়গা থেকে দিকনির্দেশনা আছে যে, আঞ্চলিক ও মহাসড়কে কোনো নছিমন, করিমন বা ভটভটি গাড়ি চলবে না।’
এ ক্ষেত্রে গতির বিশৃঙ্খলা হয়ে থাকে জানিয়ে শামসুল হক বলেন, ‘দ্রুতগতির সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের ধীরগতির গাড়িগুলো চলাচল করে। ওই ড্রাইভারের কিন্তু রোডের কোনো সেন্স নাই। তাকে যদি রোডে এভাবে বিশৃঙ্খলা করার সুযোগ দিই, তাহলে তো দুর্ঘটনা ঘটবে। আমরা কি এত দিকনির্দেশনার পরেও কিছু করেছি? করিনি।’
বিআরটিএ তার কাজ ঠিকমতো করে না বলে মনে করেন শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘হাইওয়েতে যাদের চলার কথা না তারা চলছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে। আমরা যে গাড়িগুলোকে ফিট বলব, বিআরটিএর যে ফিটনেস সনদ ব্যবস্থা, সেটি পরিহাস ছাড়া কিছুই না।
‘একটা গাড়ির ৪২টা আইটেম দেখে তাকে চলার যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেয়া সহজ কথা নয়। তবে এত কমসংখ্যক ইন্সপেক্টরে এত বিপুলসংখ্যক গাড়ির ইন্সপেকশন সম্ভব হওয়ার কথা না, যার ফলে আনফিট গাড়ি চলছে।’
চালকের প্রশিক্ষণ ঘাটতি রয়েছে বলে জানান শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘চালক প্রশিক্ষণের যে পদ্ধতি, সেটি ঠিক নেই। একটা চালককে হাইওয়েতে নামানোর আগে তার প্র্যাকটিক্যাল (ব্যবহারিক) যে পরীক্ষা হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না। সারা বিশ্বে প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। আমরা তার ধারেকাছে নাই।’
সরকার উন্নয়নকেন্দ্রিক চিন্তা করলেও সড়ক নিরাপত্তার ব্যাপারে পরিকল্পিত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে মনে করেন তিনি।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা মৌসুমি কিছু কাজ করি। কিন্তু সিস্টেমের দিকে তাকাই না। আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে রক্তক্ষরণের উন্নয়ন। এতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। অনেক পরিবার একসাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রকল্প হবে, তবে সিস্টেমের কোনো উন্নয়ন হবে না। তাই টেকসইভাবে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে গেলে বিজ্ঞান যেটা বলছে সিস্টেমকেন্দ্রিক, সেটা করতে হবে। কিন্তু আমাদের করার মতো প্রতিষ্ঠান নেই। তাদের দায়বদ্ধ করার মতো অভিভাবক নেই। তাই আমরা এর থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছি না।’
রাস্তায় সার্বক্ষণিক নজরদারি
রাস্তায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়াতে হবে বলে জানান শামসুল হক।
তিনি বলেন, ‘চোর-পুলিশ খেলে এনফোর্সমেন্ট হবে না। ২৪ ঘণ্টা রাস্তায় থাকতে হবে। উন্নত বিশ্বে চালক নিজের গাড়ি নিজে চালাচ্ছে, তাদের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, তারপরও তারা রাস্তা থেকে পুলিশ ছাড়িয়ে নিচ্ছে না। কারণ মানুষ জন্মগতভাবে সুযোগসন্ধানী। একজনের অপব্যবহার দেখে আর একজন করবে। আমাদের এখানে কিছুদিনের হেডলাইন তৈরি হলে বা কোনো দুর্ঘটনা হলে নড়েচড়ে বসে। এরপর আর খবর নেই।’
দুর্ঘটনায় দায় কার
দেশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ঢালাওভাবে পরিবহন শ্রমিকদের দায়ী করা হয়। দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলে। এ নিয়ে সাধারণ পরিবহন শ্রমিকেরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করছে।
এ বিষয়ে শামসুল হক বলেন, ‘আমি বলব, পরিবহন এমন একটা ব্যবস্থাপনা, যেখানে পলিসি লেভেলে যারা পলিসি তৈরি করেন, যারা সড়কের পরিকল্পনা করেন, ডিজাইন যারা করেন, রক্ষণাবেক্ষণ করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন এবং গাড়ির মালিক যারা, চালক যারা, ব্যবহারকারী যারা, সামগ্রিক যে বিন্যাস আছে, এখানে সবার দায়বদ্ধতা আছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনায় ঘাটতি থাকলে দুর্ঘটনা হবে। আমি সড়কের জন্য চমৎকারভাবে পরিকল্পনা করলাম, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ করলাম না। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে গেল।’
মালিকের দায়িত্ব সম্পর্কে এ অধ্যাপক বলেন, ‘চালক যদি টায়ার বদলাতে বলে, মালিক বলেন, এটা দিয়েই চালাতে হবে; না হলে আর একজন চালক নিয়ে আসব। এই মালিক দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিল। অথচ দুর্ঘটনা ঘটলে সব দায় চালকের ওপর চলে যায়।’
তিনি বলেন, ‘চালকেরা বেশি ট্রিপে বেশি রোজগার করতে চায়, কিন্তু তারা বিরতিহীনভাবে চালিয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এক পক্ষকে দায়ী করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে তাতে সিম্পটমের একটা চিকিৎসা হবে, রোগ কিন্তু থেকে যাবে। আইন করতে হবে সর্বজনীন আইন। আমাদের আইন এখনও চালকসর্বস্ব।
‘শুধু একজনকে দায়ী করে আইন করা যাবে না। চালক দেখছে, আরও অনেকের ঘাটতি আছে, কিন্তু তাদের কোনো শাস্তি বা জবাবদিহি করা হচ্ছে না। এতে তারাও মানতে চাইবে না। আন্দোলন হবে।’
পরিকল্পনাকারীদের দায় আছে
শুধু চালক নয়, বরং পরিবহন ব্যবস্থার যারা পরিকল্পনা করেন, দুর্ঘটনার উচ্চ হারের জন্য তারাও সমান দায়ী বলে মনে করেন শামসুল হক।
তিনি বলেন, ‘আমি বলব, পরিকল্পনায় যারা আছেন, তাদের ভুলের কারণে যখন দুর্ঘটনা হয়, সেটা কিন্তু বড় একটা বিষয়। তাদের অজ্ঞতার কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে চালককে তো আমি শাস্তি দিতে পারি না।
‘উন্নত বিশ্বে হলে পরিকল্পনা পর্যায়ে যাওয়া হয়। আর আমরা কিন্তু তাৎক্ষণিক বিষয়ে থাকি। এটাতে সিস্টেম ঠিক হবে না। যে দুর্ঘটনা পরিকল্পনার ঘাটতির জন্য হয়, তাকেও কিন্তু জেল-জরিমানা করতে হবে। দুর্ঘটনা হলে তারা এসি রুমে বসে থাকে। পুলিশ আর ড্রাইভার হলো ভিজিবল ফোর্স। সব রোষানল পড়ছে সেখানে।’