যত সংখ্যক শেয়ারের দর বেড়েছে, পতন হওয়া কোম্পানির সংখ্যা তার প্রায় ১০ গুণ। এক বছরের বেশি সময় ধরে চাঙা থাকা পুঁজিবাজারে হঠাৎ করেই যে পতন শুরু, সেখান থেকে বের হওয়ার যেন কোনো নাম নেই।
গত ফেব্রুয়ারির মতো টানা ছয় দিনের পতনের দিনে সোমবার এক পর্যায়ে সূচক একশ পয়েন্টের বেশি পড়ে গেলেও দিনের শেষ বেলায় অবশ্য কিছুটা উঠে।
তার পরেও ৮৯ পয়েন্ট সূচকের পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চিড় ধরা আত্মবিশ্বাস আরেকটু নড়বড়ে হলো।
গত ১১ অক্টোবর থেকে টানা যে পতন শুরু হলো, তাতে ছয় দিনেই পড়ল ২৭০ পয়েন্ট। গত ১৬ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারিও এত বেশি সূচক পড়েনি। সে সময় ৬ দিনে সূচক পড়েছিল ২২৮ পয়েন্ট।
কেবল শেয়ার দর না, সেই সঙ্গে কমছে লেনদেন। গত ২৯ জুনের পর সোমবারই সবচেয়ে কম সংখ্যক শেয়ার হাতবদল হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে।
দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৯২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২৯ জুন এর চেয় কম লেনদেন ছিল ১ হাজার ১৪৮ কোটি ৮ লাখ টাকা।
লেনদেন হওয়া কোম্পানির মধ্যে বেড়েছে কেবল ৩৩টির দর। বিপরীতে কমেছে ৩২৪টির।
গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন ঘোষণার পর আগের দিন আতঙ্কে যে পতন হয়েছিল, এরপর এমন দিন আর আসেনি। সেদিন কেবল ৬টি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছিল। তবে এত বেশি শেয়ারের দরপতন হয়নি। এর কারণ, সে সময় ফ্লোর প্রাইস থাকায় শতাধিক কোম্পানির শেয়ারের দাম একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বেশি কমা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন ফ্লোর প্রাইস না থাকায় শেয়ার দর কমার কোনো সীমা নেই।
সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে যখন দর সংশোধন শুরু হয়, প্রথমে দুর্বল ও লোকসানি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেশি কমছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে বড় মূলধনি, কোম্পানিগুলোও দর হারাতে থাকে। টানা পরপতন অব্যাহত থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
সোমবারের পতনের বিষয়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে যে পতন হয়েছে স্বল্প সময়ের জন্য এমনটি হতে পারে। তবে সূচকের পতনটি কিছুটা সময় নিয়ে হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আর সূচক শত পয়েন্টের বেশি নেমে আসলে স্বাভাবিকভাবেই সেটিকে অস্বাভাবিক মনে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতাটি তৈরি হওয়া উচিত। তারা যেন আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি না করে। তাহলে আল্টিমেটলি পুঁজিবাজার ভালো হওয়ার চেয়ে খারাপই হবে।’
আগের দিন একই ৩০ পয়েন্টের বেশি সূচক বাড়ানো ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানির শেয়ারদর কমায় সূচক কমেছে ১১.৭৫ পয়েন্ট। বড় মূলধনি অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ফোরন, ওয়ালটন, স্কয়ার ফার্মা, আইসিবি, বেক্সিমকো ফার্মা, ব্র্যাক ব্যাংক, পাওয়ার গ্রিড, শাহজিবাজার পাওয়া ও তিতাস গ্যাসের কারণে সূচক কমেছে সবচেয়ে বেশি।
সূচকের বড় পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা ১০ কোম্পানি
এই ১০টি কোম্পানির কারণেই সূচক পড়েছে ৪৯.১৭ পয়েন্ট।
অন্যদিকে যে ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে সেগুলো হলো ইউনাইটেড পাওয়ার, বিএসআরএম লিমিটেড, রবি, সাউথবাংলা ব্যাংক, ওরিয়ন ফার্মা, সোনালী পেপার, এনআরবিসি, হেইডেলবার্গ সিমেন্ট, ফরচুর সুজ ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স। তবে এসব শেয়ারের দর বৃদ্ধির হার ও শেয়ার সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় এই ১০ কোম্পানি সূচকে যোগ করেছে কেবল ১২.১৪ পয়েন্ট।
সূচক বাড়ানো ১০টি কোম্পানি যোগ করেছে কেবল ১২ পয়েন্ট
এদিন দর বৃদ্ধিতে এগিয়ে ছিল মৌলভিত্তির ‘এ‘ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো।
তবে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে গোল্ডেনসন, যেটি গত কয়েকবছর লোকসানের বৃত্ত ভেঙে এবার মুনাফার মুখ দেখছি। কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে ৯.৭৫ শতাংশ।
এছাড়া সাউথবাংলা ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে ৫.২৩ শতাংশ। বিএসআরএম এর শেয়ার দর বেড়েছে ৪.৪৭ শতাংশ।
চার খাতে শতভাগ শেয়ারের পতন
চার খাতের একটি কোম্পানির শেয়ার দরও বাড়েনি। এরমধ্যে আছে খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক, সিরামিক, ভ্রমন ও অবকাশ, পাট খাত।
খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতের ২০টি কোম্পানির সবগুলোর দর পতন সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮.১০ শতাংশ দর হারিয়েছে মেঘনা কনডেনসড মিল্ক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ দর হারিয়েছে এমারেল্ড অয়েলের দর। এপেক্স ফুডের দর কমেছে ৪.৬০ শতাংশ। জেমিনি সি ফুডের দর কমেছে ৪.১০ শতাংশ, মেঘনা পেটের ৪ শতাংশ।
খাদ্যসহ মোট চারটি খাতে সবগুলো কোম্পানির শেয়ারের দরপতন হয়েছে
ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের তালিকাভুক্ত আছে তিনটি কোম্পানি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে পেনিনসুলার ১.৯৯ শতাংশ। শেয়ার দর ৩০ টাকা থেকে কমে হয়েছে ২৯ টাকা ৪০ পয়সা।
তারপরই আছে ইউনিক হোটেল, যার শেয়ার দর কমেছে ১.৮৫ শতাংশ। সি পার্ল হোটেলের শেয়ার দর কমেছে দশমিক ২১ শতাংশ।
পাট খাতে সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে ‘জেড‘ ক্যাটাগরির জুট স্পিনার্স। ২.৯৮ শতাংশ কমেছে এর দর। এছাড়া নর্দনা জুন ২.৫০ ও সোনালী আশ ২.৫৪ শতাংশ শেয়ার দর হারিয়েছে।
সূচকের বড় পতনে নিভু আলো ব্যাংক বিমায়
অন্য খাতের যেখানে কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি নিয়ে টানাটানি সেখানে এমন পতনে মুখেও ব্যাংক ও বিমা খাতের শেয়ার দর বৃদ্ধিতে কিছুটা আশার আলো দেখা গেছে।
এদিন ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ৭টির। দর হারিয়েছে ১৯টি কোম্পানি। তবে পতনের হার বেশ কম।
৩২৪টি কোম্পানির দরপতনের ভিড়ে ব্যাংক খাতে পতনের হার ছিল কম
এ খাতের সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ২.৫৭ শতাংশ। আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ২.১৩ শতাংশ। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ১.৭৬ শতাংশ।
অপরদিকে দর বেড়েছে সাউথবাংলা, এমটিবি, এনআরবিসি, সাউথইস্ট, ইউসিবি, উত্তরা, সিটি ব্যাংক।
বিমা খাতের লেনদেনে জীবন বিমা খাতের কোনো কোম্পানির শেয়ার দর বাড়েনি। যে চারটি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে সবগুলোই সাধারণ বিমা খাতের।
লেনদেনে ৪৬টি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে।
দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক, রূপালী ইন্স্যুরেন্স ও সোনারবাংলা ইন্স্যুরেন্স।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৮৯ দশমিক ১৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৭ দশমিক ২৭ পয়েন্টে।
শরিয়াভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ২১ দশমিক ১৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫২৫ দশমিক ১৭ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ২৬ দশমিক ৫৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৮ দশমিক ৫৫ পয়েন্টে।
দিনশেষে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা।