বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বহু দূর যাবে দেশের সাইকেল

  •    
  • ১৭ অক্টোবর, ২০২১ ০৮:২৩

রপ্তানির ক্ষেত্রে ওষুধ শিল্পকে প্রায় ধরে ফেলেছে বাইসাইকেল। সারা বিশ্বে সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন অষ্টম; ইউরোপে তৃতীয়। রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি হয়ে দেখা দিচ্ছে সাইকেল। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও পূরণ করে চলেছে; কমছে আমদানি নির্ভরতা। কর্মসংস্থান বাড়ছে এ খাতে।

ওষুধের মতো নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে আরেক খাত বাইসাইকেল। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্যেও এ পণ্য শক্ত অবস্থান করে নিচ্ছে দিন দিন; আনছে বিদেশি মুদ্রা। করোনাভাইরাস মহামারি এ খাতের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। পরিবেশবান্ধব বলে সবাই এখন এর দিকে ঝুঁকছেন; দেশে-বিদেশে সবখানে।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে ১ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছে বাংলাদেশ। আর বাইসাইকেল রপ্তানি করে এসেছে ১ হাজার ১২১ কোটি টাকা।

ওষুধের চেয়ে একধাপ এগিয়ে গেছে সাইকেল। বেশ কিছুদিন ধরেই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ বাইসাইকেল চলছে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাস্তায় রাস্তায়।

ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭ দেশে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে এখন তৃতীয় অবস্থানে উঠে গেছে। এখানেই শেষ নয়, গোটা বিশ্বে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম।

পরিবেশবান্ধব বলে ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে সাইকেল জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় গত কয়েক বছর ধরেই দুই চাকার এ বাহন রপ্তানি আশা দেখাচ্ছিল বাংলাদেশকে। রপ্তানি বাজার ধরতে উদ্যোক্তারা মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন; গড়ে তুলেছেন বিশ্বমানের কারখানা।

এর সুফল আসতে শুরু করেছে। রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি হয়ে দেখা দিচ্ছে সাইকেল। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও পূরণ করে চলেছে; কমছে আমদানি নির্ভরতা। কর্মসংস্থান বাড়ছে এ খাতে।

মহামারি করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সাইকেলের চাকায় আরও উপরে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের পুরো চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা অর্জন করেছেন তারা। স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষার অংশ হিসেবে সরকার অন্যান্য খাতের মতো সাইকেলের ক্ষেত্রে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিলে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা মহামারির কারণে দেশে-বিদেশে বাড়ছে সবচেয়ে সহজ ও তুলনামূলক কম দামের ব্যক্তিগত বাহন সাইকেলের ব্যবহার। করোনা থেকে সুরক্ষার জন্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষা করে চলাচলসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর। তাই চলাচলে পারতপক্ষে গণপরিবহন এড়িয়ে চলছেন অনেকে; বেছে নিচ্ছেন ব্যক্তিগত যানবাহনকে।

আর তাতেই রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে নতুন আশা জাগাচ্ছে বাইসাইকেল। রপ্তানি বাড়াতে সরকার ও উদ্যোক্তারা নতুন ছক কষছেন।

দেশের চাহিদার অর্ধেকের মতো পূরণ করে এখন রপ্তানিও বাড়ছে। প্রতি বছরই অল্প অল্প করে বাড়ছিল রপ্তানি। গত অর্থবছরে সাইকেল রপ্তানি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

আরও বাড়াতে ১ জুলাই থেকে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা ঘোষণা করেছে সরকার। অর্থাৎ কোনো রপ্তানিকারক ১০০ টাকার সাইকেল রপ্তানি করলে সরকারের কোষাগার থেকে তাকে ৪ টাকা দেয়া হবে।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানি করে ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৬০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ১২১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি।

গত বছরের সেই ইতিবাচক ধারা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সাইকেল রপ্তানি থেকে ৩ কোটি ৭১ লাখ ৮০ হাজার ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। টাকার হিসাবে সংখ্যাটা ৩৩১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি।

চলতি অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে প্রায় ১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা (১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার) আসবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার।

রপ্তানিকারকরা আশা করছেন, এবার সাইকেল রপ্তানি থেকে লক্ষ্যের চেয়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু হয়। প্রথম দিকে এ খাত থেকে তেমন আয় না হলেও ২০০৮ সাল থেকে বাড়তে শুরু করে রপ্তানি।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাকের মতো গোটা ইউরোপের বাজারও দখল করে নেবে বাংলাদেশের সাইকেল।

বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া বাইসাইকেলের ৮০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। বাকিটা যায় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে।

সাইকেলে বিশ্ববাজার দখলের একটি সুযোগ বাংলাদেশের সামনে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে শ্রমের মজুরি কম। আমরা যে দামে সাইকেল রপ্তানি করতে পারব, তা কেউ পারবে না। মানের দিকটি মাথায় রেখে এই সুযোগটিই আমাদের কাজে লাগাতে হবে।’

সাইকেল রপ্তানি বাড়লেও তার গতি এখনও ধীর বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন। গতি বাড়াতে সরকার এবং উদ্যোক্তাদের এখনই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

‘করোনার কারণে এই যে পরিবেশবান্ধব যানবাহন সাইকেলের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে, এই সুযোগটি ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।’

শুরু থেকে এখন

২০ বছর আগে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তাইওয়ানের কোম্পানি আলিতা বাংলাদেশ লিমিটেড স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু করে। পরে এ ধারায় যুক্ত হয় মেঘনা গ্রুপ। বর্তমানে দেশের মোট বাইসাইকেল রপ্তানির প্রায় ৭৫ শতাংশই রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। আর ২০১৪ সালে ‘দুরন্ত’ ব্র্যান্ড নিয়ে আসে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

মেঘনা, প্রাণ-আরএফএল ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা ও নর্থবেঙ্গল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা থেকে উৎপাদিত সাইকেল রপ্তানি করছে।

রপ্তানিকারকরা জানান, বর্তমানে ফ্রিস্টাইল, মাউন্টেন ট্র্যাকিং, ফ্লোডিং, চপার, রোড রেসিং, টেন্ডমেড (দুজনে চালাতে হয়) ধরনের বাইসাইকেল রপ্তানি হচ্ছে।

এসব সাইকেল তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রাংশ বাংলাদেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হলেও বেশির ভাগ যন্ত্রাংশই দেশে তৈরি হচ্ছে। বিশেষত চাকা, টিউব, হুইল, প্যাডেল, হাতল, বিয়ারিং, আসন তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

১৯৯৬ সালে তেজগাঁওয়ে সরকারি বাইসাইকেল তৈরির প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় মেঘনা গ্রুপ। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে রপ্তানি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে রেড, ফেরাল ও ইনিগো ব্র্যান্ডের মাধ্যমে ইউরোপ ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার কঙ্গো, গ্যাবন ও আইভরি কোস্টে সাইকেল রপ্তানি করছে তারা।

প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০২১ সালে মেঘনা গ্রুপের বাইসাইকেল রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১০ লাখ পিস। ৪০০ থেকে শুরু করে ৬০০ ডলার মূল্যের সাইকেল রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি।

২০০৩ সালে রপ্তানি শুরু করে মেঘনা গ্রুপ। বাইসাইকেল ছাড়াও তাদের কারখানায় উৎপাদিত টায়ার ও টিউব বিশ্বের ১৮ দেশে সরাসরি রপ্তানি হচ্ছে।

৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের বাইসাইকেলও রয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাইসাইকেল রপ্তানি হয় জার্মানিতে। এরপর ডেনমার্ক ও যুক্তরাজ্যে। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, ইতালি, বুলগেরিয়া ইত্যাদি দেশে বেশি বাইসাইকেল রপ্তানি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ বাইসাইকেল অ্যান্ড পার্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও মেঘনা গ্রুপের পরিচালক লুৎফুল বারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন ইউরোপের বাজারেই বাইসাইকেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ইউরোপে আগের চেয়ে বাহন হিসেবে সাইকেলের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। সরকারও উৎসাহ দিচ্ছে এসবের ব্যবহার বৃদ্ধিতে, যার প্রতিফলন হিসেবে সড়কগুলোতে বাইসাইকেলের আলাদা লেন দেখা দিচ্ছে।

‘অতিমারি করোনায় সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি বিবেচনায় অনেকেই এখন ব্যক্তিগত যানবাহন হিসেবে সাইকেলকেই বেছে নিচ্ছেন। সে কারণে চাহিদা বেড়েছে; বেশ ভালো অর্ডার পাচ্ছি আমরা।’

তিনি বলেন, ‘রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য আমাদের আলাদা ইউনিট আছে। বিদেশি বায়াররা বেশি দামের সাইকেল অর্ডার দিলে আমরা তা তৈরি করে দিই। তবে মূলত আমরা ৪০০ থেকে ৬০০ ডলার দামের সাইকেল রপ্তানি করে থাকি।’

সরকারের সহায়তা পেলে বাইসাইকেল খাতটি আরও টেকসই করা সম্ভব উল্লেখ করে লুৎফুল বারী বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে কিছু নীতি সহায়তা চেয়েছিলাম। যেমন: বন্ড ফ্যাসিলিটি পেলে এ খাতের অনেক উপকার হবে। বন্ড ফ্যাসিলিটির পাশাপাশি নগদ সহায়তা চেয়েছিলাম। সরকার আমাদের অনুরোধ রেখেছে। চলতি অর্থবছরে সাইকেল রপ্তানির ওপর ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

‘আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। এই ঘোষণা রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এবার বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে বলে আমরা আশা করছি।’

তিনি বলেন, ‘মোটা দাগে আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি কথা বলতে চাই, পোশাক রপ্তানিতে যে নীতি সহায়তাগুলো দেয়া হয়, সেগুলো দেয়া হলে বাইসাইকেলেও তৈরি হতে পারে নানা সফলতার গল্প।’

মেঘনা গ্রুপের সঙ্গে জার্মানির একটি যৌথ অংশীদারত্বভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাইসাইকেল প্রস্তুতকারক ওই কোম্পানিটির নাম টিউব।

ঢাকার কাছে গাজীপুরে ছয়টি কারখানায় মেঘনা সাইকেল তৈরি করা হয়। এসব কারখানায় উৎপাদিত সাইকেল রপ্তানি করা হয়। মাঝে কিছুদিন স্থানীয় বাজারে বাজারজাত বন্ধ রাখা হলেও এখন আবার তা পুরোদমে চালু করা হয়েছে।

সাইকেলের রপ্তানি ও স্থানীয় বাজার সামনে রেখে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বড় বিনিয়োগ করেছে প্রাণ-আরএফএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অবস্থিত এই কারখানাটিতে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এই কারখানায় উৎপাদিত ‘দুরন্ত’ বাইসাইকেল দেশের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানিও হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এ মুহূর্তে বিশ্বের ১০টি দেশে এ কোম্পানির বাইসাইকেল রপ্তানি হয়। এর মধ্যে প্রধান বাজারগুলো হলো যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও বেলজিয়াম।

আন্তর্জাতিক বাজারে যে বাইসাইকেলগুলো যাচ্ছে, তা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হয়ে (কাস্টমাইজড) রপ্তানি হয়। এসব পণ্য তৈরি হয় বাজারভিত্তিক। সে হিসেবে লো-এন্ড বাইসাইকেলগুলো দেশের বাজারে বিক্রি হয়। অন্যদিকে বহির্বিশ্বে যায় উচ্চমানের বা হাই-এন্ড বাইসাইকেলগুলো, যেগুলোর দামই শুরু হয় ১ লাখ টাকা থেকে।

এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে করোনাকালে সাইকেলের চাহিদা অনেক বেড়েছে। প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। অনেক সময় চাহিদা মেটানোও সম্ভব হচ্ছে না। তবে এখন আমরা সক্ষমতা বাড়িয়েছি।

‘সব মিলিয়ে বছরে সাত লাখ পিস বাইসাইকেল তৈরির সক্ষমতা এখন আমাদের। আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে চাহিদাও বেশ ভালো।’

চাহিদা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তরুণদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার প্রবণতার কথা জানিয়ে কামাল বলেন, ‘রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০২২ সাল থেকে আমরা বছরে ১০ লাখ পিস সাইকেল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি।’

ইউরোপের বাজার

ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯ সালে যেখানে ইউরোপের বাজারে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম, সেখানে ২০১০ সালে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে উঠে আসে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত সেই পঞ্চম স্থানেই ছিল বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে এক ধাপ এগিয়ে চতুর্থ স্থানে উঠে আসে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার রপ্তানির মধ্য দিয়ে তৃতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ।

২০০৮ ও ২০০৯ সালে বাংলাদেশ যথাক্রমে ৩ লাখ ৭১ হাজার ও ৪ লাখ ১৯ হাজারটি বাইসাইকেল রপ্তানি করে। ২০০৭ সালে সে সংখ্যাটি ছিল ৩ লাখ ৫৫ হাজার।

২০১০ সালে রপ্তানি বেড়ে ৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০১১ ও ২০১২ দুই বছরেই সাড়ে ৫ লাখের মতো সাইকেল রপ্তানি হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রপ্তানি ছাড়িয়ে যায় ৬ লাখ।

২০২০-২১ অর্থবছরে সেই রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ১০ লাখ পিসে পৌঁছেছে।

ইউরোপের বাজারে রপ্তানির শীর্ষে আছে তাইওয়ান। এর পরের অবস্থানে আছে থাইল্যান্ড। গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে চলে এসেছে বাংলাদেশ।

থেমে নেই আমদানি

রপ্তানি বাড়লেও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে থেমে নেই সাইকেল আমদানি। এখনও দেশের চাহিদার অর্ধেকের বেশি পূরণ করে বিদেশি সাইকেল। এ জন্য আগের প্রবণতাকে দায়ী করেছেন উৎপাদকরা।

মেঘনা গ্রুপের লুৎফুল বারী বলেন, ‘আমদানি করা সাইকেলের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সেগুলোর চাহিদা বেশি। এ ছাড়া আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমদানি করা সাইকেল বিক্রি করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’

ঢাকায় মেঘনা সাইকেলের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা দামের সাইকেল বিক্রি হচ্ছে।

ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে সোমবার দুপুরে মেঘনা গ্রুপের সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভ বিক্রয়কেন্দ্রের একজন এক্সিকিউটিভ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের শোরুমে মেঘনার ভেলোস ব্র্যান্ডের ছয় ধরনের সাইকেল বিক্রি হয়। এগুলোর দাম ১৩ হাজার ৫০০ থেকে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা।’

লায়ন গ্রুপ স্থানীয় বাজারের জন্য সাইকেল তৈরি করে। এখন পর্য‌ন্ত তারা কোনো সাইকেল রপ্তানি করেনি।

ধানমন্ডি লায়ন সাইকেল স্টোরের একজন বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, তাদের সাইকেলের দাম সাড়ে ১১ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।

মূলত পুরান ঢাকার বংশালের ব্যবসায়ীরা দেশের বাইরে থেকে বাইসাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করে তা সংযোজন করে বিক্রি করেন।

বংশালে সাইকেলের বড় প্রতিষ্ঠান ‘সাইকেল হ্যাভেন’। প্রতিষ্ঠানের মালিক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মোট বিক্রি তেমন বাড়েনি। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে করোনার কারণে ছোটদের সাইকেল বিক্রি অনেক কমে গেছে। তবে দৈনন্দিন প্রয়োজনে যেসব সাইকেল ব্যবহার হয়, সেগুলোর বেচাকেনা বেড়েছে।’

দেশের অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানের সাইকেল থাকতে কেন আমদানি করেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমদানি করা সাইকেলের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সেগুলোই বেশি বিক্রি হয়। চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা আমদানি করি।’

বর্তমানে মূলত চীন ও ভারত থেকেই সাইকেল আমদানি হয়ে থাকে।

‘আমাদের রাস্তাঘাট, আবহাওয়া ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর লক্ষ রেখে আমরা সাইকেল আমদানি করি’, বলেন জাহিদ।

দেশের বাজারের কথা চিন্তা করে উদ্যোক্তারা যদি কম মূল্যের টেকসই সাইকেল তৈরি করেন, তাহলে আমদানির প্রয়োজন হবে না বলে মনে করেন তিনি।

অভ্যন্তরীণ বাজার

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বাজারে বাইসাইকেলের চাহিদা বেড়েছে। একসময় চলাচল, হালকা পণ্য পরিবহনের প্রয়োজনেই মানুষ সাইকেল ব্যবহার করতেন। সময় বদলাচ্ছে। শৌখিন ও স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেই এখন সাইকেলকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করছেন।

বর্তমানে দেশে শৌখিন সাইকেলচালকের সংগঠনও গড়ে উঠেছে। ‘বিডি সাইক্লিস্ট’ নামের একটি সংগঠনের সদস্য লাখখানেক। এ ধরনের সাইকেলপ্রেমীদের জন্য কোম্পানিগুলোও নতুন ডিজাইনের ও আধুনিক প্রযুক্তির সাইকেল নিয়ে আসছে।

বাইসাইকেল ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে দেশে সাইকেলের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০১৪ সালে বার্ষিক চাহিদা ছিল ৫ লাখ পিস। বর্তমানে তা ২০ লাখের বেশি। টাকার হিসাবে বাজারের আকার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

স্থানীয় বাজারের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ জোগান দিচ্ছেন দেশীয় উৎপাদকরা। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের বাজারের পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে সাইকেল কিংবা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এনে সংযোজন করে বাজারজাত করতেন।

চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০১১ সাল থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান মেঘনা ইনোভা রাবার কোম্পানি দেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের সাইকেল বাজারজাত শুরু করে। অবশ্য অনেক আগে থেকেই তারা বিদেশে বাইসাইকেল রপ্তানি করে আসছিল। ১৯৯৬ সালে সরকারি সাইকেল তৈরির একটি কারখানা কেনার মাধ্যমে এ খাতে প্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে নাম লেখায় মেঘনা। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি শুরু করে তারা। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি বাইসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এই কোম্পানি।

অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে প্রথম বিদেশি কোম্পানি হিসেবে মালয়েশিয়ার আলিটা (বিডি) চট্টগ্রাম ইপিজেডে কারখানা স্থাপন করে। এটি পুরোপুরি রপ্তানিমুখী একটি প্রতিষ্ঠান। এরপর তাইওয়ানের কোম্পানি ‘করভো’ ওই ইপিজেডে কারখানা করতে বিনিয়োগ করে। তাদের তৈরি সাইকেল রপ্তানির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও বিক্রি হচ্ছে।

রপ্তানিতে ইউরোপে তৃতীয় বাংলাদেশ

মেঘনা ও আরএফএল ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিটা, করভো নামের তিন প্রতিষ্ঠান ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে রপ্তানিমুখী সাইকেল তৈরির কারখানা করেছে। করোনার কারণে অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি কমে এলেও সাইকেল রপ্তানি বেড়েছে।

বর্তমানে ইউরোপের বাজারে বছরে ৬ কোটি ইউনিট বাইসাইকেল বিক্রি হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৮ লাখ ইউনিট রপ্তানি করে।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, আগামীতে শুধু স্থানীয় নয়, রপ্তানি বাজারেও বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ চীনের পণ্যের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক থাকায় ইউরোপের কয়েকটি দেশের ক্রেতারা বর্তমানে কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কা থেকে সাইকেল কিনতে আগ্রহী। এসব দেশের মধ্যে অবকাঠামোগত দিক থেকেও বাংলাদেশ সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার বাজারেও বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।

কাঁচামাল

সাইকেল তৈরিতে ব্যবহত কাঁচামালের ৫০ শতাংশ আসে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে। মূলত চেইন, হুইল ও ব্রেকের উপকরণ আমদানি করা হয়। দেশে এখন ফ্রেম, ফর্ক, রিং, টায়ার, টিউবসহ বিভিন্ন উপকরণ পুরোদমে উৎপাদন হচ্ছে। বাইসাইকেলে ব্যবহৃত রং আমদানিতে প্রায় ৯০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। উৎপাদকরা বলছেন, এই শুল্কহার অস্বাভাবিক। স্থানীয় শিল্পের বিকাশ চাইলে এ শুল্কহার কমাতে হবে। তা না হলে আমদানিনির্ভরতা কমানো যাবে না। রপ্তানি বাজারেও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে না।

দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই সক্ষম

দেশের বাজারে বছরে বাইসাইকেলের চাহিদা কত, তার সঠিক কোনো তথ্য নেই কারও কাছে। বাংলাদেশ বাইসাইকেল অ্যান্ড পার্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও মেঘনা গ্রুপের পরিচালক লুৎফুল বারী বলেন, ‘আমাদের কাছে আসলেই কোনো তথ্য নেই দেশে বছরে সাইকেলের চাহিদা কত, তবে এটা বলতে পারি, এখনও অর্ধেকের মতো আমদানি করা সাইকেল দিয়ে মেটানো হয়।

‘আমাদের মেঘনাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনের যে ক্ষমতা রয়েছে, তা দিয়ে রপ্তানির পাশাপাশি দেশীয় চাহিদার পুরোটাই মেটানো সম্ভব।’

একই কথা বলেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ বাইসাইকেল রপ্তানিতে শাপে বর হয়েছে। রপ্তানির পাশাপাশি দেশীয় বাজারের চাহিদা মেটানোরও ক্ষমতা রয়েছে আমাদের।’

ইউরোপের বাজারে রপ্তানি বাড়ার পেছনে জিএসপি সুবিধা পাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন কামাল।

এ বিভাগের আরো খবর