আধুনিক ভবন নির্মাণ হবে, পাঠকদের বই পড়ার বিস্তর জায়গা থাকবে। থাকবে বিশাল হলরুম। এমন পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৭ সালে ভেঙে ফেলা হয় রাজশাহীর ১৩৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী সাধারণ গ্রন্থাগার। শুরু হয় পাঁচতলা ভবনের নির্মাণকাজ।
ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। তবে একতলার মেঝে পর্যন্ত উঠতেই শেষ হয়ে গেছে বরাদ্দের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
রাজশাহীর প্রবীণ সাংবাদিক মুস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, পাঠাগারটি নানা কারণেই ঐতিহ্যবাহী। মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি জড়িত এর সঙ্গে। মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজি সুভাস চন্দ্রসহ অনেক খ্যাতিমান মানুষ এই পাঠাগার পরিদর্শন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্ত্র প্রশিক্ষণের ঐতিহাসিক সাক্ষীও এই প্রতিষ্ঠানটি।
ঐতিহ্যবাহী এই পাঠাগারে আছে প্রায় ৩৬ হাজার বই।
সাধারণ গ্রন্থাগারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী কামাল জানান, দিঘাপতিয়ার দানশীল রাজা প্রমথনাথ রায় পাঠাগারের জন্য ৪৪ শতাংশ জমি দান করেন। সেখানে ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দুই তলাবিশিষ্ট সাধারণ গ্রন্থাগার। এর খরচ বহন করেন কাসিমপুরের জমিদার কেদার প্রসন্ন লাহিড়ী। তার বাবার নামে ভবনের মিলনায়তনের নাম রাখা হয়েছিল ‘গিরিশ চন্দ্র হল’। সেই পাঠাগারে ১০টি কক্ষ ছিল। বই ছিল ৩৬ হাজার। এর মধ্যে ২৯টি বইয়ে স্বাক্ষর করে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঐতিহ্যবাহী এই পাঠাগার দেখে অভিভূত হওয়ার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, মোহিতলাল মজুমদার, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জলধর সেন, স্যার আজিজুল হক, সজনী কান্ত দাস, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শরৎচন্দ্র বোসসহ অনেকে।
তবে পুরোনো ভবনটির জীর্ণ দশা তৈরি হয় বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। তখন এটি সংস্কারের দাবি ওঠে।
এরপর পাঠাগারের জন্য আধুনিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় রাজশাহী সিটি করপোরেশন। ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় ভবনের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
ভারত সরকারের অনুদানে গ্রন্থাগারের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ঐতিহাসিক ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ‘সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং প্রত্নতত্ত্ব অবকাঠামো উন্নয়ন সাধন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজশাহী ও রাজশাহী মহানগরীর টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন ঘোড়ামারা সাধারণ অডিটরিয়াম নির্মাণকাজ।’
এই প্রকল্পের অধীনে পুরোনো পাঠাগারের জায়গায় ৫২ ফুট উচু পাঁচতলা ভবনের সমান স্থাপনা নির্মাণ করার কথা। যেখানে পাঠাগারের পাশাপাশি ৩০০ আসনের একটি উন্নতমানের মিলনায়তন নির্মাণের কথা রয়েছে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম আর সি সি এল-আর ই এম সি জেভি। ঠিকাদারের সঙ্গে এই নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্য ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
তবে ভবনের পিলারগুলো মাটি ছেড়ে একটু ওপরে উঠতেই বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের দাবি, পাইলিংয়ের কাজ শেষ করতেই ভারত সরকারের অনুদানের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা শেষ হয়ে গেছে। তার সঙ্গে সিটি করপোরেশন নিজের থেকে আরও ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পে মোট ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
পুরোনো ভবনটি ভাঙার সময় থেকেই এ নিয়ে সমালোচনা ছিল। এটি নির্মাণ শুরুর পর মাঝপথে থেমে যাওয়ায় নিয়ে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সমালোচনা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহম্মেদ সফিউদ্দিন বলেন, 'এটি একটি ঐতিহাসিক ভবন, যা রাজশাহীর গৌরব। বহু বিখ্যাত মানুষের আগমন ঘটেছে এখানে। যেটাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর উন্নত সমাজ গড়বার চেষ্টা হয়েছে। আমরা বর্বর, আমরা অযোগ্য। তারই কারণে আমরা এই রকম একটি মহান স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলে দিলাম।
'এটি উন্নয়ন নয়। পুরোনো ভবন রেখে দিয়েই উন্নয়ন করতে হবে। এটা যারা ভেঙেছে তারা ইতিহাসের কাছে অপরাধী। সমাজের কাছে অপরাধী। এটিকে সাংস্কৃতিক অপরাধ বলা হয়ে থাকে। এটি আইনে আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সেই কাঠের ঘোরানো সিঁড়ি তো আর পাব না। যারা এই ভবন দান করেছিলেন তাদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেললাম। তাদের নাম মুছে ফেললাম। এটি ফিরিয়ে আনা যাবে না। তারা এখানে যেটি করেছে এটি টাকার অপচয় করেছে। এখন যা বলছে তা অজুহাত। এটি আনাড়ি পাবলিক নয়। এটি দুর্নীতি হয়েছে। তাদের তদন্ত হওয়া উচিত। বিচার হওয়া উচিত। যেটাই হোক এখন দরকার একটি সুন্দর ডিজাইন করে রাজশাহীর ঐতিহ্য রক্ষা করা। ভালো মানের একটি লাইব্রেরি বানানো।'
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রিথিন এন্টারপ্রাইজের মালিক শামশুজ্জামান রতনের দাবি, ভারত সরকারের অনুদানের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের আরও ৭০ লাখ টাকা লেগে গেছে শুধু ভিত তুলতেই।
তিনি বলেন, 'মাটির অবস্থা খারাপের কারণে পাইলিং করতেই টাকা শেষ হয়ে গেছে। এর পর থেকেই কাজ বন্ধ আছে।'
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূর ইসলাম জানান, তাদের ধারণা ছিল শুধু কলামের ওপরেই ভবন নির্মাণ করা যাবে। এই প্রাক্কলনের ওপরে নির্ভর করেই ভারত সরকারের বরাদ্দ নেয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'তবে এই জায়গার মাটি খুব খারাপ। তাই সেখানে পাইলিং করা হয়। এটি করতে গিয়েই প্রকল্পের টাকা শেষ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় কাজ।
'এখন এটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৩ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রকল্পের পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে। নতুন নকশা করা হচ্ছে। এরপর টেন্ডার দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যেই কাজ শুরু করা হবে।'