নিয়মিত কোনো চিকিৎসক নেই। এ কারণে হাসপাতালেও আসতে চান না কোনো রোগী। কর্মচারীরা নিজেদের ইচ্ছামতো দিনের যেকোনো একসময় অথবা সপ্তাহে একবার এসে স্বাক্ষর করেন হাজিরা খাতায়। তাদের অনুপস্থিতিতে আউটডোরে চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন ক্লিনার।
চিকিৎসকের অভাবে এখন জনমানবহীন ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে পশ্চিম অঞ্চলের হাসপাতালটি। অথচ একসময় এটি ছিল রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রেলের যাত্রীসহ জেলার চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসা।
৩০ শয্যার হাসপাতালটিতে ৯টি নারী ও ১৮টি পুরুষ শয্যার পাশাপাশি পাঁচটি কেবিনও রয়েছে। সাত দিনের মধ্যে হাসপাতালের আউটডোর খোলা থাকে মাত্র পাঁচ দিন। চিকিৎসক না থাকায় খোলা রেখেও কোনো উপকার হচ্ছে না রোগীদের।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, হাসপাতালে একজন বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা (ডিএমও), একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা (এডিএমও) ও দুজন চিকিৎসক কর্মরত থাকার কথা। এদের চারজনেরই কেউই নেই।
তারা জানিয়েছেন, সৈয়দপুর রেলওয়ে মেডিক্যাল হাসপাতালের একজন ডিএমও অতিরিক্ত দায়িত্বে সপ্তাহে এক দিন আসার কথা থাকলেও নিয়মিত আসেন না তিনি। এ কারণে আউটডোর বিভাগে অফিসের একজন ক্লিনার ও একজন ফার্মাসিস্ট দিয়েই চলছে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটিতে নব্বই দশকের পরও প্রচুর রোগী আসতেন। এখন হাসপাতালের লোকজন ও রোগী না আসায় পুরো এলাকা মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
তারা জানান, বর্তমানে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ জন রোগী ক্লিনার আবু জাফরের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন। এরা রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের লোকজন। বাইরে থেকে কেউ এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন না।
মঙ্গলবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ইনডোরের চিকিৎসাসেবার অবস্থা আরও শোচনীয়। ৩০ শয্যার হাসপাতালে কোনো রোগীই থাকেন না। কখনও কখনও দু-একজন রোগী ভর্তি হন একেবারে নিরুপায় হয়ে বা দারিদ্র্যের কারণে। তাদের জন্য হাসপাতালে খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেলওয়ের কর্মচারীর স্ত্রী বলেন, ‘হাসপাতালের প্রাণই হলো ডাক্তার। এখানে কোনো ডাক্তার আসেন না। তাই আমরা বাধ্য হয়ে বাইরে চিকিৎসা নিই। আসলে আগে এই হাসপাতালেরই চিকিৎসা দরকার।’
চিকিৎসাসেবায় বিরক্তি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ধ্যাত, হাসপাতালেরই জন্ডিস হয়েছে। ওষুধ থাকলেও রোগীদের দেয় না। ছয়-সাত ভ্যান করে ওষুধ আসলেও পরের দিনই শেষ।’
হাসপাতালের ওয়ার্ড অ্যাটেনডেন্ট আবু জাফর বলেন, ‘ভবন চুইয়ে পানি পড়ায় স্টাফরা বসতে পারেন না। অনেক দামি জিনিস আছে, যেগুলো পানি পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার না থাকলে সবকিছুতে সমস্যা। ডাক্তার না থাকায় রোগীরা সাধারণত ভর্তি হতে চায় না।’
তিনি বলেন, ‘আমিও একজন ফার্মাসিস্ট, আমরাই রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিই।’
রেলওয়ে হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘এখানে সপ্তাহে এক দিন ডাক্তার আসেন। অন্যদিনে আমি নিজেই যতটুকু জানি, ওই অনুযায়ী এখানে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি।’
হাসপাতালের প্রধান সহকারী সারাফত হোসেন বলেন, ‘আমার এখানে কর্মরত আছেন ৩৮ জন। পদায়িত ডাক্তার সপ্তাহে এক দিন আসেন। সপ্তাহের যত কাজ থাকে সব এক দিনে মেকআপ করেন। এর মধ্যে যদি রোগী আসে তখন রোগীও দেখেন।’
তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত দায়িত্বে একজন ডিএমও থাকলেও তিনি সপ্তাহে মাত্র এক দিন আসেন। অফিসের কাজ ও যদি কোনো রোগী থাকে, তাহলে তাদের চিকিৎসা দিয়ে চলে যান। তিনি একই সঙ্গে ডিভিশনের তিনটি হাসপাতালের দায়িত্বে রয়েছেন।’
হাসপাতালের নামে একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেটি কোনো কাজে আসছে না বলেও জানান ফার্মাসিস্ট ফয়সাল আহমেদ।
লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালের ডিভিশনাল রেলওয়ে চিকিৎসা কর্মকর্তা (ডিএমও) ডা. মো. আনিছুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বর্তমানে একই সঙ্গে তিনটি হাসপাতালের দায়িত্বে আছি। হাসপাতালটি রেলওয়ের অধীনে রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিলে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হাসপাতালটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেয়া উচিত।’
লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডাক্তাররা গেজেটেড অফিসার। তারা পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পান। রেলের ডাক্তাররা নন-ক্যাডারে নিয়োগ পান। এ কারণে তারা এখানে থাকতে চান না। পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগের পর তারা চলে যান। স্বাভাবিকভাবেই তখন এখানকার পদগুলো শূন্য হয়।’
রোগীদের খাবারের ব্যবস্থা না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে রোগীদের খাবারের ব্যবস্থাও আছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ ছাড়া ডাক্তার না থাকার কারণে রোগীরাও তেমন একটা আসেন না। এ কারণে রোগীদের খাবারও দেয়া হয় না।’
হাসপাতালে ৫৩টি পদের বিপরীতে বর্তমানে মাত্র ২৪ জন কর্মরত রয়েছেন বলেও জানান ডিআরএম শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ।