গত এক দশক ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম অনেকটাই স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করেই এর বাজার তেতে উঠেছে। পাশাপাশি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ডিমের দামও, যা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই মাস আগেও যে মুরগি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো, সেটি এখন গিয়ে ঠেকেছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। ডিমের ডজন ৯০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা।
ব্রয়লারের পাশাপাশি বেড়েছে লেয়ার, দেশি ও সোনালি জাতের মুরগির দামও। এই চার জাতের মুরগিতে গত কয়েক দিনে কেজিতে দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি বাজারে সরবরাহে টান পড়েছে। এর কারণ হিসেবে করোনাকালের সংকটের কথা তুলছেন তারা। বলছেন, সে সময় নানা কারণে অনেক খামারে মুরগি তোলা হয়নি। এ কারণে জোগান কমে গেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির ফলে এই সমস্যার সমাধানের আশাও করছেন তারা।
আবার করোনাকালে বিধিনিষেধের মধ্যে বিয়ে আটকে গেলেও এখন ব্যাপকহারে ভোজের আয়োজনকেও বাজারে সরবরাহে ঘাটতির একটি কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন এক বিক্রেতা।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারিতে মুরগির দাম অনেক। তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই কমিয়ে বিক্রির সুযোগ নেই।
ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, খামারে মুরগির উৎপাদন সামান্য কমেছে। আবার বাজারে বেড়েছে এর চাহিদা। এ কারণেই দাম বেড়েছে।
ডিম ব্যবসায়ীদের যুক্তি- মুরগি ও মাছের দাম বাড়ায় চাপ পড়েছে ডিমের ওপর। তা ছাড়া কয়েক দিন ধরে বাজারে ডিম আসছে কম। সবকিছু মিলেই বেড়েছে দাম।
টিসিবির তথ্যে বৃদ্ধির হার
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ।
গত মাসে এই সময়ে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১৩৫-১৪০ টাকায়। এখন সেটার দাম বেড়ে হয়েছে ১৬৫-১৭৫ টাকা।
আর এক বছরের ব্যবধানে এসব মুরগির দাম বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। গেল বছর এ সময়ে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজির দাম ছিল ১২০-১৩০ টাকা।
তবে টিসিবি বলছে, এক মাসের ব্যবধানে হালিপ্রতি ডিমের দাম কমেছে ১.৩৭ ভাগ। সংস্থাটির প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে খামারে উৎপাদিত এক হালি ডিম ৩৫-৩৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত মাসের এ সময়ে যা বিক্রি হয়েছে ৩৫-৩৮ টাকায়।
কেন বাড়ছে দাম
এ প্রশ্নে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম বলেন, ‘করোনার সময় ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন কমে গেছে। এখন মুরগির চাহিদা বেশি, কিন্তু বাজারে চাহিদামতো সরবরাহ নেই। ডিমের অবস্থাও একই। ফলে দাম বাড়ছে।’
একই বাজারের মুরগি বিক্রেতা শাহীন জানান, হঠাৎ সরবরাহ কিছুটা কমে যাওয়ার কারণে পাইকাররা দাম বাড়িয়েছে। সরবরাহ বেড়ে গেলে দামও আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
রাজধানীর নিকুঞ্জ-২ আবাসিক এলাকার এক মুরগি বিক্রেতা তুললেন অন্য একটি প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘করোনার সময় অনেক বিয়া আটকে গেছিল। এখন প্রচুর বিয়া হচ্ছে। এর লাইগ্যা মুরগির অনেক চাহিদা। দাম বাড়ার এইডা একটা কারণ।’
দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার দেড় বছরে লোকসান ও টানা বন্ধের কারণে অনেক খামারি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া মহামারিকালে খামারে মুরগির চাহিদা অনেক কমে গিয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে বাচ্চা উৎপাদনও কমে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে একটা মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে অনেক খরচ পড়ে যায়। আগে একটা বাচ্চা উৎপাদনে ১০-১২ টাকা খরচ হতো, এখন সেটা বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে মুরগির দামও বেড়েছে। আগে প্রতি মাসে আড়াই থেকে তিন লাখ বাচ্চা উৎপাদন করতাম, সেটা এক লাখে নামিয়ে আনতে হয়েছিল। তবে এখন পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।’
বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প ফোরাম মনে করে, পোলট্রি ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল সয়ামিল রপ্তানির কারণে দেশের বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম বেড়েছে।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, পোলট্রি শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল সয়ামিলের দাম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাচ্চার দামও বেড়েছে কয়েক গুণ।
প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতকারী শিল্পের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিয়াব) সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ‘সয়াবিন মিল বা সয়ামিল রপ্তানির সিদ্ধান্তে এখন উৎপাদনকারীরা দেশে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে এবং কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি করছে। যে কারণে ভোক্তা ও শিল্প দুই পক্ষই ক্ষতির মুখে পড়ছে। কাঁচামালের সংকটের কারণে ফিড উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং দামের ওপর প্রভাব পড়ছে।
তদারকি করবে কে?
চাল, তেল, চিনিসহ কয়েকটি পণ্যের দাম তদারকি হলেও মুরগি এবং ডিমের দায়িত্ব নেয় না সরকারি কোনো সংস্থা বা দপ্তর। মাঝেমধ্যে বাজারে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কিন্তু মুরগি এবং ডিমের বাজার তদারকি দেখা যায় না।
উৎপাদন, চাহিদা ও মজুত নিয়ে তেমন পরিসংখ্যান দেখা যায় না। ফলে নানা সময়ে দাম বৃদ্ধি, বাজারে সংকট এবং নৈরাজ্য অবস্থা তৈরি করে অর্থ হাতিয়ে নিলেও দেখার যেন কেউ নেই।
ক্রেতার নাভিশ্বাস
কারওয়ান বাজারে সপ্তাহে নিয়মিত ব্রয়লার কেনেন আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, ‘চড়া দামের কারণে গরুর মাংস অনেক আগেই খাওয়া বাদ দিয়েছি। বছরে, ছয় মাসে খেতে পারি। এখন দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মুরগির মাংসও আর খাওয়া হবে না। আগে ২০০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে পুরো মুরগি পেতাম। এখন প্রতি কেজির দাম ১৮০ টাকা।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সব ধরনের মুরগির দাম বেড়েছে, যা অস্বস্তিকর। কারণ অন্যান্য পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। করোনার সংকটের মধ্যেও এমন দাম বাড়েনি।’
শরিফুল হক নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘ডিমের দাম ক্রমান্বয়ে ওঠানামা করছে। প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় এই পণ্যের দাম এখন বাড়তি। ফলে সাধারণ মানুষের কিনে খাওয়া সম্ভব নয়।’