লেনদেনের শীর্ষে বেক্সিমকো- গত প্রায় এক বছর ধরে পুঁজিবাজারে নিয়মিত ঘটা এই বিষয়টি গত এক সপ্তাহে হয়নি একবারও।
আগস্টে ও সেপ্টেম্বরে এক দিনে নিয়মিত দেড়শ থেকে দুইশ কোটি টাকা, কোনো কোনো দিন তার চেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার গত দুই দিনেও একশ কোটি টাকা লেনদেন হয়নি।
এর মধ্যে গত দুই দিন লেনদেন একেবারেই কমে গেছে। গত মঙ্গলবার এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন সংখ্যক শেয়ার লেনদেন হয়েছে। পর দিন কিছুটা বেড়েছে অবশ্য।
গত জুলাই ও আগস্টে কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়লেও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ১১ কোটির বেশি শেয়ার কিনে কোম্পানিতে তাদের হিস্যা বাড়িয়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরে এসে কিছু শেয়ার তারা বিক্রি করেছে, যেটি অরর্ধকোটর কাছাকাছি।
গত বছরের মাঝামাঝি থেকে পুঁজিবাজার চাঙা হয়ে উঠার পর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে, তার মধ্যে শীর্ষ সারিতেই আছে বেক্সিমকো।
করোনার কারণে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে ২০২০ সালের মে মাসে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু হওয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১৩ টাকার ঘরে। চলতি মাসের শুরুতে তা এক পর্যায়ে হয়ে যায় ১৫১ টাকা ২০ পয়সা।
শেয়ার দর এভাবে বাড়ার পেছনে কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ ও আয় বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে এসেছে।
২০২০ সালে শেয়ার প্রতি ৫১ পয়সা আয় করা কোম্পানিটির গত ৩০ জুন শেষ করা অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আয় করেছিল ১৪ পয়সা।
কিন্তু পরের প্রান্তিক থেকে আয় বাড়তে থাকে। এই সময়ে কোম্পানিটি পোশাক রপ্তানিতে ব্যাপক আয় করে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে পিপিই রপ্তানি করতে ৯০০ কোটি টাকায় পিপিই পার্ক করে বেক্সিমকো। এখান থেকে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য নেবে যুক্তরাষ্ট্র।
এর সুফল এরই মধ্যে পেয়েছে বেক্সিমকো। গত ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৪ টাকা ৩০ পয়সা। এর মধ্যে প্রতি প্রান্তিকেই আয় বাড়ছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ২ টাকা ৩৮ পয়সা।
আবার বেক্সি পাওয়ার নামে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়নে একটি ২৮০ মেগাওয়াট ও পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় নির্মিত হচ্ছে ৫৫ মেগাওয়াটের আরও একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এর মধ্যে গাইবান্ধার কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে তিস্তা সোলার লিমিটেড আর পঞ্চগড়েরটি নির্মাণ করছে করতোয়া সোলার লিমিটেড নামে কোম্পানি। এই দুটি কোম্পানির ৭৫ শতাংশের মালিক বেক্সিমকোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেক্সি পাওয়ার। বেক্সি পাওয়ারের ৭৫ শতাংশের মালিক আবার বেক্সিমকো লিমিটেড।
এই দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদনে আসবে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়নের জন্য বেক্মিমকো তিন হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড ছেড়েছে।
বেক্সিমকোর শেয়ার দর বৃদ্ধির পেছনে আরেক কারণ হচ্ছে তাদের সহযোগী কোম্পানির দুটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পাওয়া
এই দুটি ঘটনায় বেক্সিমকোর শেয়ার দরে উল্লম্ফনের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিতে তাদের শেয়ারের হিস্যা বাড়িয়ে চলছিলেন।
গত জুলাই মাসে মোট শেয়ারের ৪.৬ শতাংশ হিসেবে ৪ কোটি ৩ লাখ ১০ হাজার ৬৬৮টি শেয়ার কেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
আগস্টে তা আরও বাড়ে। এই মাসে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ হাজার ২৯৫টি শেয়ার কিনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিতে তাদের মালিকানা বাড়ায় ২৬ দশমিক ০৯ শতাংশ পর্যন্ত।
জুলাই মাসে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যখন বেক্সিমকোর চার কোটির বেশি শেয়ার কেনে, তখন এর দর ছিল ৮৯ থেকে ৯২ টাকার মধ্যে।
আগস্টে তারা যখন প্রায় ৭ কোটি শেয়ার কেনে, তখন এই দাম বেড়ে যায়। ৯১ টাকা থেকে ১১১ টাকা ৩০ পয়সায় গিয়ে দাঁড়ায় দর।
সেপ্টেম্বরে দাম বাড়ে আরও। এই সময়ে শেয়ার দর বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৭ টাকা ২০ পয়সা। আর এই সময়টায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন শেয়ার না কিনে কিছু বিক্রি করেছে। আগের মাসের তুলনায় ০.৫৩ শতাংশ শেয়ার কমে এখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরের মালিকানা দাঁড়িয়েছে ২৫.৫৬ শতাংশ।
অর্থাৎ এই মাসে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ৪৬ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯০টি শেয়ার বিক্রি করেছেন।
লভ্যাংশ ঘোষণার সভার আগে দাম ও লেনদেন কমছে
অক্টোবরের শুরুতে কোম্পানিটির শেয়ার দর ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে একটি স্বস্তিকর খবর পায় বেক্সিমকো। তিন হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ডের মধ্যে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৭৫০ কোটি টাকা তোলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের কারণে আইপিও ভেস্তে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি পেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক এই বন্ডে বিনিয়োগ করায় সেটি আর হয়নি।
এর মধ্যে আগামী ২১ অক্টোবর লভ্যাংশ ঘোষণার তারিখ জানিয়েছে কোম্পানিটি। কিন্তু এই সময়ে এসে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। লেনদেনের পাশাপাশি কমছে দামও।
গত ৬ কর্মদিবসের মধ্যে চার দিন দরপতন হয়েছে। দুই দিন একদিন ২০ পয়সা ও একদিন ১০ পয়সা করে বেড়েছে।
এই সময়ে শেয়ার দর ১৩ টাকা ২০ পয়সা কমে বুধবার দাম দাঁড়িয়েছে ১৩৮ টাকা ১০ পয়সা।
দামের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে কমে গেছে লেনদেন। গত ৪ অক্টোবর হাতবদল হয়েছিল ১ কোটি ২১ লাখ ৩৮ হাজার ৫১৯টি শেয়ার। এরপর থেকে ক্রমেই কমতে থাকে লেনদেন। মঙ্গলবার হাতবদল হয় ২৮ লাখ ৬১ হাজার ৬৫১টি শেয়ার। বুধবার খানিকটা বাড়লেও লেনদেন ৫০ লাখও ছাড়ায়নি। হাতবদল হয় ৪৭ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪টি শেয়ার।
টানা এক বছর বিপুল পরিমাণ শেয়ার লেনদেনের পর অক্টোবরে এসে তা কমছে
এই পরিমাণ শেয়ার লেনদেন নিঃসন্দেহে খারাপ না। তবে গত এক বছর লেনদেনের চার্ট দেখলে সেটিকে কমই মনে হবে। এই সময়ে এক দিনে তিন কোটিরও বেশি শেয়ার হাতবদল হয়েছে দুই তিন। দেড় কোটি থেকে দুই কোটি শেয়ার হাতবদল হয়েছে নিয়মিতই।
এই সময়ে এককভাবে কোম্পানিটি ৩২০ কোটি টাকা লেনদেনে ইতিহাসও আছে।
গত ৪ জানুয়ারি বেক্সিমকো লিমিটেডের ৪ কোটি ৩ লাখ ৬৮ হাজার ২৩৩টি শেয়ার।
তারপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ২৫ জানুয়ারি, এদিন মোট ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ১৩৩টি শেয়ার লেনদেন হয়। সেদিন শেয়ার প্রতি দর ছিল ৮৯ টাকা ১০ পয়সা। ফলে এককভাবে শুধু বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩২০ কোটি ২২ লাখ।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি বেক্সিমকোর শেয়ার লেনদেন হয় ২ কোটি ৮২ লাখ ৫৩ হাজার ১৩৭টি। তারপর ২ মে শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ ৫ হাজার ৭৭১টি। এভাবে গত আগস্ট পর্যন্ত কোটি শেয়ারের নীচে খুব কম সময়েই হাতবদল হয় বেক্সিমকোর।