ভয়াবহ সেশনজট, শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষসংকট, আবাসন এবং উন্নয়নকাজে স্থবিরতা, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা সংকটের মধ্যে ১৪ বছরে পা রাখল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
১৩ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ব্র্যান্ডিং করার পরিকল্পনা। একই সঙ্গে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন পেলেও চালু হয়নি রোকেয়া স্টাডিজ ।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে যেসব অবকাঠামোগত কাজ হয়েছে তার থেকে খুব বেশি এগোয়নি আর। ফলে সেদিক থেকেও নাজুক অবস্থানে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠাবর্ষিকী থাকলেও রাখা হয়নি বড় কোনো আয়োজন। করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলে এমন আয়োজনে ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর জানায়, দিবস ঘিরে সকালে জাতীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, বৃক্ষরোপণ, ভার্চুয়াল আলোচনা সভা এবং জোহরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তবে সেসবে ছিল না খুব বেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ।
২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে উচ্চ শিক্ষার এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম বদলে করা হয় ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’।
২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পরিত্যক্ত ভবনে ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, বিগত ১৩ বছরে অনেক প্রাপ্তি থাকলেও এখনো বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে রংপুর অঞ্চলের কিশোর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়টি। এক যুগেও নানা সংকটের কোনো সমাধান হয়নি।
সেশনজট
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভয়াবহ সেশনজটের কবলে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকাংশ বিভাগেই রয়েছে দেড় থেকে সাড়ে ৩ বছরের সেশনজট। ফলে ৬-৭ বছরেও শেষ হচ্ছে না অনার্স। যা শিক্ষার্থীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। করোনাকালীন অনলাইনে ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে সেশনজটমুক্তের উদ্যোগ নেয়া হলেও বেশ কিছু বিভাগ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ রেখেছে ক্লাস-পরীক্ষা।
আবাসিকসংকট
বিশ্ববিদ্যালটিতে সাড়ে ৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র তিনটি হল। এর দুটি ছেলেদের, একটি মেয়েদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে আরেকটি হল নির্মাণাধীন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, এখন ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধার বাইরে রয়েছেন।
মানদণ্ডেও পিছিয়ে
বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য অন্তত একজন শিক্ষক থাকবেন।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে রয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির ২১ বিভাগে ৮ হাজার ৩৯৩ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক ১৮৮ জন। সে হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১:৪৪।
স্থবিরতা উন্নয়ন প্রকল্পে
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের দুটি ভবন শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট এখনো নির্মাণাধীন। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি কাজের উদ্বোধন হলেও শেষ হয়নি কাজ।
এমনকি স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণাধীন অবস্থায় পড়ে আছে। এখনো অস্থায়ীভাবে নির্মিত আছে শহীদ মিনার। এসব প্রকল্পে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি।
হয়নি রোকেয়া স্টাডিজ
নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াতের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হলেও অবহেলায় রোকেয়া স্টাডিজ। রোকেয়াকে জানতে ও তার দর্শন চর্চায় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে অনুমোদন পেলেও ১৪ বছরেও চালু হয়নি রোকেয়া স্টাডিজ। নেই কোনো ম্যুরাল। রংপুরের পায়রাবন্দে রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার দাবি থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
ফটক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশের চারটি গেট থাকলেও, নেই আকর্ষণীয় প্রধান ফটক। সাবেক ভিসি ড. কলিমউল্লাহ একটি প্রধান ফটক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেও কাগজে-কলমেই আটকে আছে বাস্তবায়ন।
কবে খুলবে বিশ্ববিদ্যালয়?
করোনাকালীন দীর্ঘ বন্ধের পর ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে বা ক্লাস কবে শুরু হবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি প্রশাসন।
যা বললেন উপাচার্য ও সংশ্লিষ্টরা
উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ বলেন, ‘নানান সংকটের মধ্য দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ বছরে পদাপর্ণ করেছে। সেশনজটমুক্ত করা, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, আধুনিক চর্চাকেন্দ্র ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি সম্প্রসারণ করা হবে। এসব সমস্যা দূর করে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে আমি আশাবাদী।’
বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. রেজাউল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলাম, সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা চাই প্রজ্ঞা, মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন উপাচার্য। যার দূরদৃষ্টি থাকবে, যথার্থ শিক্ষানুরাগী, সংবেদনশীল, শিক্ষার্থীবান্ধব থাকবেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়কে যেন আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় করা হয় সে দিকটায় গুরুত্ব দেয়া জরুরি।’
বর্তমান উপাচার্য ড. হাসিবুর রশীদের মেয়াদ চলছে ৫ মাস।