নাটোরের হোসেন অ্যান্ড অ্যাগ্রো খামারের স্বত্বাধিকারী সারোয়ার হোসেন ইমন। শহরতলির জাঠিয়ান ভবানীপুর এলাকায় নিজের ১৪ বিঘা জমিতে বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি গড়ে তুলেছেন মাছের খামার। করোনাভাইরাস মহামারিতে সবাই যখন ধরাশায়ী, তখন তিনি দেখছেন নতুন সম্ভাবনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইপিআরএস (ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেম) পদ্ধতিতে সব ধরনের মাছ চাষ করা গেলেও ইমন আপাতত রুই ও গ্লাসকার্প মাছ চাষ করছেন। যন্ত্রপাতি বসানোসহ খামারে এ পর্যন্ত তার বিনিয়োগ ৭০ লাখ টাকা। এক বছরের মধ্যেই এই টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশার কথা জানান তিনি।
ইমন জানান, কয়েক দফা চীনে গিয়ে আইপিআরএস প্রযুক্তি দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। এরপর গত বছরের শেষের দিকে চীন থেকে আইপিআরএস প্রযুক্তি আমদানি করে মৎস্য খামার গড়ে তোলেন। চীনা প্রযুক্তিবিদ ও প্রকৌশলী এসে সব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম স্থাপন করে দিয়ে যান। আমেরিকার সোয়াবিন কোম্পানির সহযোগিতায় তিনি আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন।
ইমন আরও জানান, আধুনিক পদ্ধতিতে একটি পুকুরে একাধিক চেম্বার করে মাছ চাষ করা যায়। এতে উৎপাদন খরচ কমসহ অল্প জায়গার পুকুর থেকে অধিক মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। এ ছাড়া প্রযুক্তির সাহায্যে খাবার সরবরাহ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা হওয়ায় এ পদ্ধতিতে মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। আর তেমন কোনো রোগবালাই হয় না।
আইপিআরএস পদ্ধতিতে কম জায়গাতেই বেশি মাছ পাওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার একর ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর তৈরির দরকার পড়ে না। এ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত মাছের স্বাদ নদীর মাছের মতোই। তাই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটাতে চান ইমন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পর দ্বিতীয় প্রকল্প হিসেবে নাটোরে তিনিই আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় আগ্রহী হচ্ছেন অন্য চাষিরা। এ খামারে উৎপাদিত মাছ বিদেশেও রপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান ইমন।
খামারের মার্কেটিং কর্মকর্তা আবু সাদাত সালাউদ্দিন জানান, খামার এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করায় বাড়িতে বসে মাছ চাষ পর্যবেক্ষণ করা যায়। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাষিরা এই খামার দেখতে আসছেন। অনেকেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর মাহফুজুল হক জানান, আইপিআরএস বা ইনপন্ড রেসওয়ে সিস্টেম পদ্ধতিতে একটি পুকুরে একাধিক চেম্বার তৈরি করে নদীর মতো কৃত্রিম স্রোত সৃষ্টি করা হয়। প্রতিটি চেম্বারে মাছের ঘনত্ব বেশি থাকে এবং স্রোতের কারণে মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে।
এ ছাড়া পাম্পের মাধ্যমে বর্জ্য উঠিয়ে ফেলার কারণে অন্য পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতিতে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি মাছ উৎপাদন করা যায়। আর উৎপাদন খরচও তুলনামূলক কম। ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে একেকটি চেম্বারে ২২ থেকে ৩২ টন পর্যন্ত মাছ উৎপাদিত হয়।
ওয়ার্ল্ড ফিসের গবেষক কানিজ ফাতেমা জানান, খাদ্য গ্রহণের পর নির্গত মাছের বিষ্টা ফুল ও ফলগাছে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পাঁচ বছরেও মাছ চাষ করা পুকুরের পানি পরিবর্তন করতে হয় না।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিনই নতুন আইপিআরএস প্রযুক্তি মাছ চাষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা নিতে দূর-দূরান্ত থেকে নাটোরে আসছেন চাষিরা।
ময়মনসিংহ থেকে আসা মাছচাষি মাহবুব পলাশ জানান, আইপিআরএস মাছ চাষ দেখে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এভাবে মাছ চাষ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে অল্প খরচে গুণ-মানসম্পন্ন অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব। এর মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও মাছ রপ্তানি করা যাবে মাছ।’
রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা প্রকল্পটি দেখতে এসে বলেন, ‘আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ দেখে আমি আপ্লুত হয়েছি। তবে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ থাকতে হয়। তাই কৃষি খাতের মতো এই খাতেও বিদ্যুতের খরচ কমানো দরকার। বিষয়টি আমি সংসদে উপস্থাপন করব।’