বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ক্লাসে ক্লাসে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত, ফেরাবে কে

  •    
  • ১২ অক্টোবর, ২০২১ ০৮:২০

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা কর্মকর্তাদের উদ্যোগ নেই বলে জানান অভিভাবকরা। এক অভিভাবকের দাবি, করোনাকালে বন্ধ থাকা বকেয়া বেতন মওকুফ করলে অনেক শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

একমাস হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলেও বেশিরভাগ স্কুলে এখনও শিক্ষার্থী কম। এদের অনেকে ঝরে পড়েছে বলে আশঙ্কা শিক্ষকদের। দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, তা নির্ধারণ করতে পারছে না শিক্ষা অফিসগুলো।

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা উদ্যোগ নেবেন। আর অভিভাবকদের দাবি, শিক্ষার্থীদের বকেয়া টাকা মওকুফ করে দিলে অনেক শিক্ষার্থী ফিরে আসবে।

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চর সাহাভিকারী এলাকার রবিউল ইসলাম ছিল কাজীর হাট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এবার তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার কথা, কিন্তু করোনার দীর্ঘ ছুটিতে বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় তার পরিচয়ই বদলে গেছে।

রবিউল এখন ভাড়ায় চালিত অটোরিকশাচালক। প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে রিকশা চালিয়ে পুরো দিনের আয় সে সন্ধ্যায় তুলে দেয় মায়ের হাতে। তার ওপর তৈরি হয়েছে পরিবারের নির্ভরশীলতা। তাই বিদ্যালয়ে ফেরা নিয়ে পরিবার থেকেও কোনো রকম তাগিদ নেই।

রবিউল জানায়, বাবা-মা ও তারা দুই ভাই নিয়ে চার সদস্যের পরিবার। তার বাবা একটি ওয়ার্কশপে চাকরি করতেন। বড় ভাইও বাবার সঙ্গে কাজ শিখতেন। করোনাকালে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওয়ার্কশপের চাকরি চলে যায়। একই সঙ্গে তার ভাইও বেকার হয়ে পড়ে। পরে সংসারের হাল ধরতে রবিউল রিকশা চালানো শুরু করে। তার ভাই গ্রামে গ্রামে ফেরি করে সবজি বিক্রি করছে।

রবিউল বলে, তাদের দুই ভাইয়ের রোজগারের টাকা দিয়ে বাবার ওষুধ খরচ আর পরিবারের খরচ চলে। সবজি বিক্রি করে তার ভাই তেমন লাভ করতে পারে না। পরিবারের কথা ভেবে রিকশা চালানো ছাড়তে পারছে না। তবে রিকশা চালানোর পাশাপাশি তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে, কিন্তু মা-বাবা দুজনই অসুস্থ হওয়ায় একই সঙ্গে কীভাবে দুদিক সামাল দেবে, ভেবে পাচ্ছে না।

আরেক কিশোর রিকশাচালক মো. মাসুদ জানায়, করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরে বেকার বসে না থেকে এলাকার একজনের কাছ থেকে দৈনিক ১০০ টাকায় ভাড়ায় একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নেয় সে। সে একটি মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। দীর্ঘ বিরতির পর মাসুদের মাদ্রাসা খুলেছে। কিন্তু পরিবারের চাহিদা মেটাতে শ্রেণিকক্ষে ফেরা হচ্ছে না মাসুদের।

মাসুদ বলে, তারা চার ভাই-বোন। বাবা নেই। এত দিন বড় ভাইয়ের আয়ে পুরো পরিবার চলত, কিন্তু করোনাকালে ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন। এরপর থেকে সংসারের খরচ চালানো নিয়ে তার মা বেকায়দায় পড়েছেন। ঘরে ছোট এক বোন আছে। সংসারের হাল ধরতে রিকশা চালানো পেশায় তাকে যোগ দিতে হয়েছে। এখন রিকশা চালানো বাদ দিলে তার মা আর বোন বেকায়দা পড়বে।

জেলার বিভিন্ন দোকানে, ওয়ার্কশপে ও যানবাহনে কাজ করা অন্তত ১০-১২ কিশোরের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা করোনাকালে পরিবারের কথা চিন্তা করে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার কাহিনি শোনায়।

ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা কর্মকর্তাদের উদ্যোগ নেই বলে জানান অভিভাবকরা।

ডা. ফারুকুর রহমান নামের এক অভিভাবকের দাবি, করোনাকালে বন্ধ থাকা বকেয়া বেতন মওকুফ করলে অনেক শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

আবু তাহের নামের এক অভিভাবক জানান, ‘আমি রিকশাচালক। আমার ছেলে স্কুলে গেলে স্যারেরা টাকা খুঁজে। সে জন্য আর স্কুলে দিচ্ছি না।’

ফেনী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, ‘কলেজজীবনে অনেকে ঝরে যায়। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় আর ছেলেরা বিদেশে অথবা কর্মজীবনে চলে যায়। তবে আমার দেখা অনেক ছাত্র-ছাত্রী শুধু করোনার কারণে ঝরে গেছে, যারা পড়াশোনায় ভালো ছিল, যাদের ফ্যামিলিও শিক্ষিত ছিল। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় অনিশ্চিত গন্তব্য দেখে তারা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।’

ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শাওরীন তাবাসসুম ইফরান জানায়, তাদের ক্লাসের তিন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারা পড়াশোনায় মধ্যম সারির ছিল।

গোহাডুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খোন্দকার মহিউদ্দিন জানান, কয়েকজন ঝরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখনও সব ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত হয়নি। এই সপ্তাহে বোঝা যাবে কতজন অনুপস্থিত। ধারণা করা হচ্ছে, কিছু শিক্ষার্থী শিশুশ্রমে চলে গেছে।

মাহবুবা আক্তার উপমা বলেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে আসলে পড়াশোনা হয় না। প্রয়োজনে কম ক্লাস হোক, তবুও প্রতিষ্ঠান খোলা থাকুক। প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে পড়াশোনা হয়।

ফেনীর শাহীন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করা সুলতান মাহমুদ টিপু জানান, ‘৯ মাস আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে আসছি। মনে করছিলাম আর স্কুল-কলেজ খুলবে না। আজ কলেজ খুলে দেয়াতে খুবই কষ্ট পেলাম। কলেজজীবনে ক্লাস করতে পারলাম না। বড়ই আফসোস।’

এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ঝরে পড়ার সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, কিছু শিক্ষার্থী ঝরে যাবে। তাদের ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকদের বোঝানোর জন্য আমরা শিক্ষকদের বলেছি। ফেনী জেলায় ৫৬২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সবকটি চালু করা হয়েছে।’

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার কাজী সলিম উল্যাহ বলেন, ‘ফেনী জেলায় ২০০টি মাধ্যমিক স্কুল, ১০৫টি মাদ্রাসা, ৩৪টি সরকারি-বেসরকারি ও প্রাইভেট কলেজ রয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে গেছে কি না, সেটি আমরা জরিপ করছি। তবে আমরা কিছু উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি পালন করব, যাতে করে যেসব শিক্ষার্থীকে এখনও ফিরিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে, তাদের আনা যায়।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আরও কম। এর কারণ হিসেবে বাল্যবিবাহকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকসহ সচেতন মহল। এ ছাড়া শহর এলাকার নিম্ন আয়ের অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার গ্রামে চলে যাওয়াসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন বলেও মনে করছেন তারা।

ফেনীর সোনাগাজী বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ১২০ জন। এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১১৪। এর মধ্যে স্কুল খোলার প্রথম দিনে ৯০ এসএসসি পরীক্ষার্থী ছাড়াও কিছুসংখ্যক অন্যান্য শ্রেণির মেয়ে শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়। প্রতিটি শ্রেণিতে গড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান বলেন, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। তার বিদ্যালয়ের প্রতি শ্রেণিতে প্রায় ২০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বাল্যবিবাহ ও পরিবারের অসচ্ছলতাকে দায়ী করেন। অনেকের পরিবার করোনায় বেকায়দা পড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। এরপরও তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত তিনি অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছেন।

এ বিভাগের আরো খবর