দেশে এ মুহূর্তে পেঁয়াজের মজুত যথেষ্ট আছে। আমদানি করা আরও পেঁয়াজ বাজারে ঢুকছে। এ অবস্থায় পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
অথচ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীসহ সমন্বয়কারী অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে আগামী এক মাস দেশে পেঁয়াজের দাম কিছুটা নাজুক (বাড়তির দিকে) থাকবে। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের এমন মন্তব্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ গত ৯ মাস চাহিদা মেটানোর পরও উৎপাদনকারী প্রধান ৯টি জেলায় এই মুহূর্তে ৪ লাখ ২১ হাজার ৪২৪ টনের মজুত রয়েছে। তার ওপর নভেম্বরের মাঝামাঝি কিংবা শেষ দিকে বাজারে উঠবে দেশি পেঁয়াজ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বা হওয়ার পথে আরও প্রায় ৪ লাখ টন আমদানি করা পেঁয়াজ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রায় ৩ লাখ ৭১ হাজার টন পেয়াজ আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, যার থেকে ২ লাখ ৭৬ হাজার ২১৯ টন পেঁয়াজের আমদানি নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ এ পরিমাণ পেঁয়াজ বাজারে এসেছে।
দাম বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক
বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সরবরাহকৃত এ তথ্য সঠিক হলে মজুত পেঁয়াজ দিয়েই দেশে অনায়াসে দুই মাসের চাহিদা পূরণ হয়। এর পাশাপাশি ইতিমধ্যে যে আমদানি করা পেঁয়াজ দেশে ঢুকেছে, তা দিয়ে পরবর্তী মাস ডিসেম্বরও পার করে দেয়া যায়। অর্থাৎ ঘাটতি মৌসুম মোকাবিলা সম্ভব দাম বৃদ্ধি ছাড়াই। সে ক্ষেত্রে দাম বাড়ার প্রশ্ন ওঠে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘গত ৯ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন পেঁয়াজের দাম ছিল ২০৪ দশমিক ০৭ ডলার। তা বেড়ে ৯ অক্টোবর দাঁড়িয়েছে ৩৪৩ দশমিক ৯০ ডলার। যেখানে দরবৃদ্ধির হার ৬৯ শতাংশ।’
বাণিজ্য সচিব আরও জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে পেঁয়াজের প্রথম ফলন বাজারে গড়াবে নভেম্বরের শেষ দিকে। নতুন ফলন ওঠার আগে পণ্যটির দাম কিছুটা নাজুক থাকবে।
মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রবণতার কারণেই মন্ত্রণালয় থেকে পেঁয়াজের বাজার নাজুক থাকার ইঙ্গিত দেয়া হয়।
প্রধান আমদানি বাজারে দাম কত দেশে যে পেঁয়াজ আমদানি হয়, তার ৮০ ভাগই আসে ভারত থেকে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের তথ্যমতে, ভারতের নয়াদিল্লি, নাসিক, মুম্বাই, কলকাতা ও বেঙ্গালুরুতে পেঁয়াজের দাম এখন ১৯ থেকে ৩০ রুপির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দাম বিবেচনায় নিলেও দেশে পেঁয়াজের দাম ৫ শতাংশ শুল্কসহ কেজিতে ৫৫ টাকার উপরে বিক্রি হওয়ার কথা নয়। অথচ দেশে পেঁয়াজের দাম উঠেছে ৭৫-৮০ টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি অনুবিভাগ) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানি পেঁয়াজেরও ৮ থেকে ১০ শতাংশ প্রসেস লস হয়।
‘এর সঙ্গে আগের তুলনায় বাড়তি দাম, সম্পূরক ও পরিবহণজনিত খরচের পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনা খরচসহ মুনাফা বিবেচনায় নিতে হয় ব্যবসায়ীদের। তবে এটাও ঠিক, হঠাৎ করে যে হারে দাম বাড়ানো হয়েছে, তা ছিল অযৌক্তিক। আমরা অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কঠোর বার্তা দিয়েছি।’
যে কারণে দাম বাড়ার প্রতিযোগিতা বাংলাদেশে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর – এই তিন মাস পেঁয়াজ উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে একটা ঘাটতি মৌসুম (দুই উৎপাদন মৌসুমের মধ্যবর্তী সময়) থাকে। এ সুযোগে বাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টিপাত থেকে শুরু করে নানা বাহানায় পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
এ ছাড়া পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে আইপি ইস্যু করাসহ বিভিন্ন স্তরের অনুমোদন নিতে হয়। এতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগে, তেমনি পরিবহন জটিলতায়ও পড়তে হয়। এর ফলে সময়মতো পেঁয়াজ পৌঁছাতেও দেরি হয়। এ ছাড়া পেঁয়াজ আমদানিতে আরোপ করা রয়েছে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক। এসব কারণে ঘাটতি মৌসুমে পেঁয়াজের দাম বাড়ে।
এবারও এসব কারণে বাজারে ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজ উঠেছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। যদিও দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ এবার ছিল না। দেশে বছর জুড়ে পেঁয়াজের মোট চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২৯ দশমিক ৫৫ লাখ টন। এ হিসেবে দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়।
তবে উৎপাদন পরবর্তী পেঁয়াজের সংরক্ষণকালে প্রক্রিয়াজাতকরণজনিত ২৫ শতাংশ প্রসেস লস হয়। একইসঙ্গে আমদানিকৃত পেঁয়াজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি হয় ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদার সৃষ্ট ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর ৮ থেকে ৯ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।
ঝাঁঝ কমাতে সমন্বিত উদ্যোগ দেরিতে হলেও পেঁয়াজের দাম কমাতে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ মজুতের তথ্য প্রতিদিন হালনাগাদ করার পাশাপাশি এক দিনে ইস্যু করা হচ্ছে পেঁয়াজ আমদানির আইপি অনুমোদন।