বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের ‘নিরাময়’ কবে

  •    
  • ১১ অক্টোবর, ২০২১ ১৭:৫৬

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি শর্তের হিসাব করা হয়, তবে এর কোনোটিই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তবুও তারা লাইসেন্স পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এদের অনেক মালিক আবার নিজেরাই মাদকাসক্ত ছিলেন। তারা মনে করেন মাদকাসক্তের চিকিৎসা তাদের চেয়ে কেউ ভালো বোঝে না।’

ছাত্রজীবনে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন রাজধানীর শহীদবাগ এলাকার বাসিন্দা রুবেল হোসেন (ছদ্মনাম)। মাদক ছাড়াতে তাকে চার দফা রাজধানীর চারটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে লম্বা সময় রেখেছিল পরিবার। রুবেল এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন, কিন্তু মনে পুষে রেখেছেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের তিক্ত অভিজ্ঞতা। তার ভাষায়, এসব জায়গায় টাকা দিয়ে কেনা হয় চিকিৎসার নামে নির্যাতন।

রুবেল জানান, সবশেষ তাকে রাখা হয়েছিল রাজধানীর ভাটারার সেতু মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সেখানে তিন মাসে তার পরিবার লাখ টাকা খরচ করেছে, কিন্তু চিকিৎসার নামে চলেছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিউজবাংলাকে রুবেল বলেন, ‘আমরা ৯-১০ জন একটা রুমে থাকতাম। আলাদা আলাদা বেড ছিল। আমাদের দিয়ে হাসপাতালের বাথরুম পরিষ্কার করানো, থালা-বাসন মাজার কাজ করাত। হাসপাতালে সব নিয়ন্ত্রণ করত স্টাফরা। তাদের কথার বাইরে গেলে মারধর করত। খাটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত। আমাদের মাঝে কেউ অসুস্থ হলে পাশের গলির ফার্মেসিতে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাত। তাদের নিজেদের কোনো ডাক্তার ছিল না।

‘প্রতিদিন স্টাফরাই আমাদের বোঝাত যে মাদক নেয়া ভালো না, সমাজ খারাপ বলে, পরিবার শেষ হয়ে যায় ইত্যাদি। আমাকে ভালো খাবার দেয়ার কথা বলে আমার পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিত, কিন্তু আমাকে হাসপাতালের রেগুলার খাবারই দেয়া হতো। প্রতিদিন দুপুরে ডিমের তরকারি, ডাল-ভাত আর রাতে সবজি, ডাল-ভাত দেয়া হতো। আর সপ্তাহে এক দিন থাকত মুরগির মাংস। আমাদের জীবন ওই ছোট্ট ঘরেই বন্দি ছিল।’

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে এক তরুণ। ফাইল ছবি

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিপীড়নের দিনগুলো এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় বলে জানান রুবেল। বলেন, ‘মাসে একবার পরিবারের সদস্যরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন, কিন্তু তখনও সামনে হাসপাতালের লোকজন থাকত। আমরা নির্যাতনের বিষয়ে কিছু বললে এরপর চলত আরও বেশি নির্যাতন।’

সেতু মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিক নিজেও একসময় মাদকাসক্ত ছিলেন বলে জানান রুবেল। এর আগে আরও যে তিনটি কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন সেগুলোতেও একই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

রুবেলের মতো মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অনেকের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শর্তে চিকিৎসক, নার্স, খোলামেলা ও ভালো পরিবেশ নিশ্চিতের কথা বলা হলেও দেশের অধিকাংশ লাইসেন্সধারী মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে দেখা যায় এর কোনোটিই মানা হচ্ছে না।

মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রতি ১০ জন রোগীর জন্য অন্তত একজন মেডিক্যাল অফিসার, একজন মনোরোগ চিকিৎসক, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও জীবন রক্ষাকারী উপকরণ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সংরক্ষণে থাকতে হবে। নিরাময় কেন্দ্রে একজন মাদকাসক্ত রোগীর জন্য গড়ে কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা এবং স্বাস্থ্যসম্মত নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে।

নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার বিষয়ে বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত রোগীকে প্রশিক্ষিত লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রোগীকে আলাদাভাবে বিশেষ কক্ষে রাখতে হবে। ওই কক্ষেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন উপসর্গে কী ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা যাবে এমনটাও উল্লেখ করা আছে নির্দেশনায়। তবে মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ হিসেবে রোগীকে নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের কথা বলা আছে।

সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক কোনো মাদকাসক্ত রোগীকে নির্যাতনের সুযোগ নেই, কিন্তু নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে রোগী নির্যাতনের অভিযোগ অহরহ।

২০২০ সালের ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান পুলিশের এএসপি আনিসুল করিম শিপন। এরপরই এসব মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সাবেক পরিচালক মো. নুরুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘নিরাময় কেন্দ্রগুলোর সার্বিক চিত্র এখন মোটামুটি ভালো বলা যায়। কারণ, পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর পর আমরা কেন্দ্রগুলোতে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়েছিলাম। সে সময় আমরা চারটি প্রতিষ্ঠানকে একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছি, আর কিছু প্রতিষ্ঠানকে তাদের সেবার মান বাড়ানোর জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছিল। গত কয়েক মাস ধরে আমরা কোনো নির্যাতনের অভিযোগ পাইনি।’

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর চিত্র

সরকারি হিসাব অনুযায়ী মাদকাসক্তের চিকিৎসার জন্য দেশের ৪৪ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে মোট ৩৫২টি। ২০ জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো নিরাময় কেন্দ্রই নেই।

সরকারের সব শর্ত মেনে চলে দেশে এমন কোনো বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নেই বলে জানালেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি শর্তের হিসাব করা হয় তবে এর কোনোটিই লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তবুও তারা লাইসেন্স পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এদের অনেক মালিক আবার নিজেরাই মাদকাসক্ত ছিলেন। তারা মনে করে মাদকাসক্তের চিকিৎসা তাদের চেয়ে কেউ ভালো বোঝে না।’

দেশে সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে চারটি- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায়। সরকারি চারটি নিরাময় কেন্দ্র ধুঁকছে জনবল-যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে। কোনোটিতেই চিকিৎসার জন্য জরুরি বিভাগ নেই।

এসব অভিযোগের সত্যতা জানতে রাজধানীর বেশ কয়েকটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। তবে এ বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এর মধ্যে সেতু মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে গেলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। আর হলি লাইফ ও আশা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গেলে জানানো হয়, এ বিষয়ে মন্তব্য করার মতো কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কোনো কর্মকর্তার হদিস পাওয়া যায়নি। কোনো কর্মকর্তার ফোন নম্বরও দেয়া হয়নি।

ঢাকা কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আবাসিক মনোরোগ চিকিৎসক কাজী লুৎফুল কবীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে আমাদের সরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি ভালোভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময় চিকিৎসা দেয়ার পর পুনর্বাসন করতে হয়। আমাদের সেই সুবিধা না থাকায় মাদকাসক্তদের চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে যেতে হয়। ফলে এর চিকিৎসার দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়া যায় না।’

এই সংকট নিরসনে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে লুৎফুল কবীর বলেন, ‘আমাদের সরকারি চারটি কেন্দ্রকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের পাশাপাশি আরও তিনটি বিভাগে তিনটি কেন্দ্র চালুর প্রক্রিয়া চলছে। এগুলো হয়ে গেলে এই সংকটের অনেকটাই সমাধান হবে।’

তদারকির অভাব

মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। এর চিকিৎসায় বেশি জড়িত মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। তবে এ চিকিৎসার সার্বিক তদারকির দায়িত্বভার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদের মতে, বাংলাদেশ মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। আর এমনটা হচ্ছে শুধু সঠিক তদারকির অভাবে।

তিনি বলেন, ‘মাদকাসক্তের চিকিৎসা করবেন চিকিৎসকরা। আর কোনো প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিকঠাক চলছে কি না এটা দেখবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কিন্তু আমাদের এখানে এই বিষয়ে তদারকি করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তারা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়। এই লাইসেন্স নিয়ে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে যা তা করে যাচ্ছে।

‘চিকিৎসার প্রটোকলের বদলে তারা রোগীদের টর্চার করে। টর্চার তো কোনো চিকিৎসা হতে পারে না। লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী প্রতিটি নিরাময় কেন্দ্রে ডাক্তার-নার্স থাকার কথা থাকলেও তার কোনোটিই নেই অনেক কেন্দ্রের। এগুলোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অ্যাঙ্গেজমেন্ট জরুরি, তারা যেভাবে হাসপাতালগুলোকে মনিটর করে একইভাবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোকেও মনিটর করবে।’

এ বিভাগের আরো খবর