নিজেকে সুন্দর ও পরিপাটি রাখতে বাড়ছে লেজার থেরাপি দিয়ে মেদ কমানোর প্রবণতা। এই থেরাপি কতটা নিরাপদ বা কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কি-না এসব নিয়ে জানাশোনা নেই বেশিরভাগ মানুষের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কারণে মেদ বাড়ছে সেই কারণ চিহ্নিত না করে লেজার থেরাপি দিয়ে মেদ কমিয়ে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
যেভাবে দেয়া হয় থেরাপি
বডি শেপিংয়ের জন্য নন সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট লেজার থেরাপি। এই ট্রিটমেন্টে আল্ট্রাসাউন্ড ওয়েভের মাধ্যমে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানের চর্বি সেলগুলো ভেঙে দেয়া হয়। যার ফলে শরীরের কাঙ্ক্ষিত আকৃতি অর্জন করা সম্ভব হয়। শরীরের প্রকারভেদে চার থেকে পাঁচটি সেশনের মাধ্যমে এই থেরাপি দেয়া হয়। প্রতি সেশনে ১৫ মিনিট করে নির্দিষ্ট স্থানে একটি মেশিনের মাধ্যমে তাপ দিয়ে মেদ ঝরিয়ে দেয়া হয়।
লেজার থেরাপি গ্রহীতাকে অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না। এই থেরাপি ব্যথাহীন। স্থুলতা অনুযায়ী সুষম খাদ্য তালিকা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়।
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন সুমী নিউজবাংলাকে বলেন, মেদ কমানোর জন্য যে লেজার থেরাপি এটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে মেদ কমানো হয়। মেশিনের মাধ্যামে তাপ দিয়ে মেদটা কম সময়ে কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে এটা সাময়িক। মেদ কমে আসার পর যদি খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে আগের চেয়ে বেশি মেদ ফিরে আসে দুই সপ্তাহের মধ্যে। খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ না করলে পরে নানা অসুবিধা দেখা দেয়।
নেই কোনো নীতিমালা
লেজার থেরাপির বিস্তার দেশে দিন দিন বাড়তে থাকলেও এ বিষয়ে এখনও সরকারি কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি।
তবে মেদ কমানোর মেশিন বিদেশ থেকে আনতে হলে তা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন লাগে। আর যারা এই সেবা দিচ্ছেন তাদের সনদ নেয়া আছে কি না তা দেখভাল করার দায়িত্ব বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি)। কিন্তু এসব মানা হচ্ছে খুব কমই।
এই থেরাপিতে একজন প্লাস্টিক সার্জন থাকতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ডার্মাটো সার্জন দিচ্ছেন লেজার থেরাপি। শুধু তাই নয় চিকিৎসক না হয়েও শুধু বিদেশ থেকে দু-এক সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে চেম্বার খুলে বসছেন। ফলে এই সেবা দিনে দিনে চলে যাচ্ছে ‘নন মেডিক্যাল’ ব্যক্তিদের হাতে। যে কারণে অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন। সেবা গ্রহণকারীদের একদিকে টাকা যাচ্ছে, অন্যদিকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
কীভাবে চলছে এই সেবা
কীভাবে লেজার থেরাপি সেবা দেয়া হচ্ছে রাজধানীতে তার খোঁজ নিয়েছে নিউজবাংলা। চলতি বছরের গত মার্চ থেকে এমন সেবা দিয়ে আসছে ‘লেজার লিপো’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীতে তাদের দুইটি শাখা রয়েছে। প্রতিদিন ওই ক্লিনিকে ১৫ থেকে ২০ জনকে এই সেবা দেয়া হচ্ছে। তাদের ক্লিনিকে কোনো প্লাস্টিক সার্জন নেই। দুই ডার্মাটো সার্জন দিয়ে এই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
যে মেশিন দিয়ে থেরাপি দেয়া হচ্ছে সেটার অনুমোদন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবুল কাশেমের কাছে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘লেজার থেরাপি দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয় না।’
প্লাস্টিক সার্জন ছাড়া এই সেবা দিচ্ছেন কেন, এমন প্রশ্নে আবুল কাশেম দেখালেন করোনাভাইরাসের অজুহাত। তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক সার্জন নেয়ার জন্য আলোচনা চলছে। করোনাকালে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকার কারণে আসলে প্লাস্টিক সার্জন নেয়া সম্ভব হয়নি। কিছু দিনের মধ্যে প্লাস্টিক সার্জন হবে।’
খরচ কেমন
লেজার থেরাপি দিয়ে মেদ কমাতে প্রতি সেশনে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে এক হাজার টাকা নেয়া হয়। তবে বেসরকারিভাবে এই চিকিৎসা নিতে প্রতি সেশনে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। রাজধানীর কয়েকটি লেজার থেরাপি সেন্টার থেকে এ তথ্য জানা যায়।
রোগী ভেদে তিন দিন পরপর মোট পাঁচটি থেকে ছয়টি সেশন করাতে হয়, যাতে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ হয়। যে মেশিনের মাধ্যমে লেজার থেরাপি দেয়া হয় সেই মেশিনে একটি রিসিভার রয়েছে। এটি একটানা চার ঘণ্টা ব্যবহার করা যায়।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বে লেজার থেরাপি দিয়ে বিভিন্ন রোগের সেবা দেয়া হচ্ছে। দক্ষ চিকিৎসক ও সঠিক উপায়ে লেজার থেরাপি দিলে দ্রুত সময়ে মেদ কমে আসে; বড় কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না। যেহেতু সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি হয় একটি মেশিনের মাধ্যমে তাই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও মেশিনের ওপর নির্ভর করে।
প্লাস্টিক সার্জন শারমিন সুমী বলেন, যদি ভালো মেশিন হয় তাহলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তেমন হওয়ার সুযোগ নেই। থেরাপি দেয়ার পর অনেক সময় মেদ লিভারে গিয়ে জমে। তাই অনেকের ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
একটি সরকারি হাসপাতালে এই সেবা
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতে বেসরকারিভাবে লেজার থেরাপির মাধ্যমে মেদ কমানোর চিকিৎসা সেবা দেয়া হলেও সরকারিভাবে শুধু শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটেই এই সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে সবার জন্য নয়। প্রতি সপ্তাহে রোববার নির্বাচিত কিছু মানুষকে এই সেবা দেয়া হয়ে থাকে। হাসপাতালটিতে গত বছর চালু হয় লেজার থেরাপি।
সবার এই সেবা নেয়া উচিত নয় বলে সর্তক করেছেন প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন সুমী। তিনি বলেন, শুধু থেরাপি দিয়ে মেদ কমিয়ে ধরে রাখা সম্ভব নয়, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। নিয়মিত শরীর চর্চা করতে হয়।
শারমিন সুমী বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, আমাদের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যারা সেবা নিয়েছেন কিন্তু সঠিকভাবে জীবন পরিচালনা করেননি তাদের এই থেরাপি কাজে আসেনি। এমনকি বেসরকারিভাবে এই সেবা নিয়েছেন কিন্তু পরে আর কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করেননি তাদের মেদ কমার চেয়ে বেশি বেড়ে গেছে। এমন রোগীও আমরা পেয়েছি।’
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন সুমী
যাদের দরকার লেজার থেরাপি
প্লাস্টিক সার্জন শারমিন সুমী বলছেন, বেশি মোটা মানুষের এই সেবা নেয়া উচিত না। যারা খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে চলে তাদের এই সেবা নেয়া ভালো। যারা সেবা নিতে আসবে তাদেরকে আগে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ শুনে থেরাপি নেয়া উচিত।
দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান নয়
লেজার থেরাপি দিয়ে মেদ কমানো দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমাধান নয়। ১৫ দিনে হয়ত অনেকের মেদ কমে আসছে, কিন্তু এটা স্থায়ী থাকছে না। অনেকের ক্ষেত্রে এই থেরাপি নেয়ার এক মাসের মধ্যে আবার আগের মেদ ফিরে আসছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনোলজি (হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহজাদা সেলিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চর্বি দূর কারার জন্য লেজার থেরাপির অনুমোদন এখনও কোনো দেশ দেয়নি। এমনকি কোনো দেশ তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এর অনুমোদন দেয়নি। যারা এই পদ্ধতিতে মেদ কমাচ্ছে তারা নিয়মের বাইরে করছে।’
এ বিষয়ে দেশে একটি নীতিমালা তৈরির জন্য কাজ চলছে বলেও জানান এই বিশেষজ্ঞ।