দেশে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, মৃদুল তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শ্রেণিকক্ষে যাওয়া হয়নি তার। সময় কেটেছে চার দেয়ালের বন্দি জীবনে। পড়াশোনা যা হয়েছে, তার পুরোটাই অনলাইনে।
সেভাবেই ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে সখ্য বেড়েছে মৃদুল সরকারের। এখন সে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গ আর শ্রেণিকক্ষে সশরীরে ক্লাসের প্রতি তার আগের সে টান নেই। বরং মোবাইল, ট্যাব নিয়ে সময় কাটাতেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তার।
মৃদুলের এই বদলে যাওয়ার কথা জানালেন তার বাবা অমল সরকার। তিনি বলেন, ‘স্কুল খোলার আগে অনলাইনে ক্লাস করার জন্য তাকে ট্যাব দেয়া হয়। ট্যাব দিয়ে সে ক্লাসও করত আর মাঝে মাঝে ইউটিউবে ভিডিও দেখে, গেমস খেলে সময় কাটাত।’
করোনাকালের এই শিক্ষা-উপকরণটি এখন তার সর্বনাশের কারণ বলে মনে করেন মৃদুলের বাবা। তিনি বলেন, ‘ইদানিং ইউটিউবে ভিডিও দেখা আর গেমস খেলা তার নেশায় পরিণত হয়েছে। জোর করেও ওকে ট্যাব থেকে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।’
করোনাকালেও মৃদুলের মতো করেই ঘরবন্দি জীবন কাটিয়েছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী শম্পা আক্তার। কথা হয় শম্পার মা জলি আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন বাসায় থাকতে থাকতে মেয়েটার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। কিছু বললেই রেগে যায়। আর কোনো কিছুতেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।’
চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ইফতেখারের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্ন তার বাবা মনিরুল ইসলাম। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘ঘরে থাকতে থাকতে ছেলেটা যেন কেমন হয়ে গেছে। পড়াশোনার কথা বললেই কেমন যেন চুপ হয়ে যায়।’
বলে-কয়ে কখনও পড়ার টেবিলে পাঠালে তার মনোযোগ থাকে না বলেও জানান বাবা মনিরুল। তিনি বলেন, ‘পড়ার টেবিলে বসে, বই সামনে থাকে, কিন্তু তার মনোযোগ থাকে না পড়াশোনায়। সুযোগ পেলেই মোবাইল নিয়ে বসতে চায়, আর হঠাৎ করে যেন আনমনা হয়ে যায় ছেলেটা।’
নভেম্বর মাসে এসএসসি পরীক্ষা, তাই এ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই বাবা মনিরুলের।
স্কুল বন্ধের সময় শিশুদের মধ্যে ডিভাইস ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে কয়েকগুণ। ফাইল ছবি
করোনাভাইরাস মহামারির থাবায় গোটা বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এসব ঘটনা জানান দিচ্ছে, সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে শিশুরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘরবন্দি জীবন প্রভাব ফেলেছে তাদের মনোজগতে।
জীবনযাত্রার এই বদলে যাওয়াকে বলা হচ্ছে ‘নিও নরমাল’। এই নিও নরমাল জীবনে এসে শিশুদের সখ্য বেড়েছে ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে। শুধু বিনোদন হিসেবে নয়, শিক্ষা-উপকরণ হিসেবে ডিজিটাল ডিভাইসের কদর বেড়েছে তাদের জীবনে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ‘দ্য স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় আবদ্ধ থাকার ফলে শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য ও সার্বিক সুস্থতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
৫ অক্টোবর প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী প্রতি সাতটি শিশুর মধ্যে অন্তত একজন লকডাউনের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১৬০ কোটির বেশি শিশুর পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় শিশুর মনোজগতে বিশেষ প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ সমস্যা উত্তরণে বাবা-মা এবং শিক্ষকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের প্রাত্যহিক রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। বলা যায়, এ সময়ের বেশির ভাগ সময় শিশু ছিল ঘরবন্দি। এতে তাদের মনোজগতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।’
এ সমস্যা উত্তরণে পরিবার ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসার পরামর্শ মেহজাবীন হকের। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবার ও শিক্ষকদের এবং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে এ সমস্যা কেটে যাবে। তবে এর জন্য কিছুটা সময় লাগবে।’
করোনায় শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে যে প্রভাব পড়েছে, তা থেকে উত্তরণে তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম) আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হলো শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকে মূল্যায়ন করা, নিও নরমাল জীবনের সঙ্গে শিশুদের মানসিকভাবে মানিয়ে নেয়ার জন্য তৈরি করা এবং শিশুদের অভিভাবকদের ‘কোয়ালিটি টাইম’ দেয়া।’’
স্বাভাবিক পরিবেশে শিশুকে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার।
তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারিতে শিশুর পড়াশোনায় অনেক ক্ষতি হয়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন যেহেতু স্কুল খুলতে শুরু করেছে, তাই এর জন্য স্বাভাবিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া জরুরি। তাই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রয়োজনে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলেই আস্তে আস্তে পড়াশোনার ক্ষতি পোষানো সম্ভব হবে।’