দুগ্ধদায়ী মাতা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন আল-আমিন চৌকিদার নামে বরগুনার এক পুরুষ। বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের ছোট পোটকাখালী এলাকার এই বাসিন্দার বিকাশ নম্বরে সরকারের চালু করা এ ভাতা ২০১৯ সাল থেকে প্রতি মাসে এসে জমা পড়ছে।
ওই তালিকায় আল-আমিনের স্ত্রী সুখি বেগমও ভাতা পাচ্ছেন। সুখির নামও রয়েছে তালিকায়।
আল-আমিন ও সুখি জানান, তাদের দুজনের নাম ওই তালিকায় তোলার জন্য তারা জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী নাজমুল হাসানকে ৬ হাজার টাকা দিয়েছেন। এর ফলে তালিকায় তাদের নাম উঠে গেছে।
নিম্ন আয়ের কর্মজীবী দুগ্ধদায়ী মায়েদের (ল্যাকটেটিং মাদার) জন্য এই সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম চালু করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর এটি বাস্তবায়ন করে।
মায়ের স্বাস্থ্য এবং শিশুর পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কর্মসূচির আওতায় শিশুর জন্ম থেকে ৩৬ মাস পর্যন্ত প্রত্যেক মাকে সর্বমোট ২৮ হাজার টাকা সহায়তা দেয়া হয়।
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। তাতে বলা হয়েছে, দুগ্ধদায়ী মায়েদের বয়সসীমা ২০ থেকে ৩৫ বছর হতে হবে। শহরে ‘ল্যাকটেটিং মাদার’ ও গ্রামাঞ্চলে ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ দুটি আলাদা নামে এই কর্মসূচি চলে আসছে। শহরে ‘ল্যাকটেটিং মাদার’ কর্মসূচিতে নীতিমালার শর্ত পূরণ সাপেক্ষে শুধু পৌর শহরের বাসিন্দা নারীরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
তবে বরগুনায় এ কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়ম ও ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সুবিধাভোগী তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির নামে ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে জেলা মহিলা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও তার অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঘুষ নিয়েও অনেককে ভাতা সুবিধার আওতায় আনতে পারেননি ওই কর্মকর্তারা। তবে ঘুষের টাকা ফেরত দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন একজন ভুক্তভোগী।
জেলা মহিলা অধিদপ্তর বরগুনা কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পৌরশহরে এ কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৫০ জন। অভিযোগ উঠেছে, নীতিমালা অনুসরণ না করে ঘুষের বিনিময়ে ওই কর্মসূচিতে অনেক সুবিধাভোগীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এখানে ভাতা পাচ্ছেন এমন নারীদের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, শিশু নেই এমন একাধিক নারী, শিশু ও দুগ্ধদানকারী মায়ের বয়সের শর্ত পূরণ হয় না এমন একাধিক নারী এবং এমনকি একজন পুরুষও এই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন। এ ছাড়া পৌর শহরের বাসিন্দা নন, এমন শতাধিক নারীর এই তালিকায় স্থান হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এসব অনিয়মের মূল কারণ ঘুষ-বাণিজ্য। সুবিধাভোগীরাই জানিয়েছেন, বরগুনা মহিলা অধিদপ্তরের অফিস সহকারী নাজমুল হাসান ও জেলা মহিলাবিষয়ক কমকর্তা মেহেরুন নাহার মুন্নি পরস্পরের যোগসাজশে ঘুষের বিনিময়ে তাদের এমন সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন।
আনিসা আক্তার নামের এক নারী ল্যাকটেটিং মাদার কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনিসা আক্তারের জাতীয় পরিচয়পত্রে স্বামীর নাম নেই, তবে বাবার নাম ওয়াহেদুল ইসলাম, তার ঠিকানা মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন সড়ক, আমতলী পৌরসভা। ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আনিসা আক্তার বরিশালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এবং তিনি বরিশালেই বসবাস করেন।
একইভাবে বরগুনা সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়নের দক্ষিণ মনসাতলি এলাকার বাসিন্দা স্বর্ণা সরকারের শিশু নেই; অথচ তিনি কর্মসূচির আওতায় নিয়মিত ভাতা পেয়ে আসছেন।
বরগুনা পৌর শহরের কলেজ ব্রাঞ্চ সড়কের বিলকিচ বিনা। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স এখন ৫৩ বছর। তার সন্তান এখন লেখাপড়া করছে দশম শ্রেণিতে। তিনিও ২০১৯ সালে এই প্রকল্পের অধীনে সহায়তা পাচ্ছেন উৎকোচের বিনিময়ে।
নীতিমালা অনুযায়ী ২০ থেকে ৩৫ বছরের দুগ্ধদায়ী মায়েদের এ ভাতা পাওয়ার কথা। এলাকায় গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে দেখা যায়, বিনার বয়স ৫৫ বছর। অথচ তিনিও রয়েছেন ভাতা সুবিধার আওতায়। বিলকিস বেগম অকপটে স্বীকার করেন, তিনি ৬ হাজার টাকা দিয়ে নাম তালিকাভুক্ত করিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ৭ হাজার টাকা চাইছিল, আমি ৬ হাজার টাকা দিয়ে নাম উঠাইয়া টাকা পাইতেছি।’
একইভাবে নিয়মিত ভাতার আওতায় আছেন এমন অর্ধশতাধিক নারীর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে নিউজবাংলা। ওই নারীদের সঙ্গে সরাসরি কথা হয়েছে প্রতিবেদকের। এদের অধিকাংশই পৌর শহরের বাইরের বাসিন্দা। এ ছাড়া অনেকের বয়স ও শিশুর বয়স নীতিমালার শর্ত পূরণ করে না।
যেভাবে ঘুষ নেয়া হয়েছে
সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়নের ভোটার মরিয়ম আক্তার বীথি। মাস্টার রোলে চাকরি করছেন পৌরসভার স্বাস্থ্য বিভাগে। ২০১৭ সালে বরগুনার মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অফিস সহকারী নাজমুল হাসানকে ৪ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ভাতা সুবিধার আওতায় আসেন তিনি। পরিচয়ের সুবাদে বীথিকে ঘুষের প্রস্তাব দেন নাজমুল হাসান।
২০১৯ সালের কর্মসূচিতে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য বীথির কাছে নারীদের তালিকা চান নাজমুল। জনপ্রতি সাড়ে ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে এ প্রকল্পের আওতায় যেকোনো এলাকার মায়েদের সহায়তা পাইয়ে দেবেন বলে জানান নাজমুল।
এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে মরিয়ম আক্তার বীথি পৌর শহর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৬৯ মায়ের নাম এবং এসব মায়ের কাছ থেকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা ঘুষ তুলে নাজমুলের হাতে দেন। ওই তালিকার ১৬৯ জনের মধ্যে ৪৬ জনকে ভাতা সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং তারা বিকাশের মাধ্যমে নিয়মিত ভাতা তুলছেন। কিন্তু ১৬৯ জনের মধ্যে বাকি ১২৩ জনের নাম বছরের পর বছর ঘুরেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি বীথি। তারা ফেরত পাননি ঘুষের টাকা।
এ নিয়ে বীথির সঙ্গে নাজমুলের বিবাদ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বিষয়টি সালিশ বৈঠকে গড়ায়। সদর উপজেলা বিআরডিবির চেয়ারম্যান রুহুল আমিন সালিশ করে নাজমুলকে নাম অন্তর্ভুক্তি অথবা টাকা ফেরতের শর্ত দেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও নাম বা টাকা ফেরত কোনোটাই দেননি অফিস সহকারী নাজমুল।
বঞ্চিতদের চাপে বিপাকে পড়েন বীথি। অবশেষে গত ২১ অক্টোবর বরগুনা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগকারী মরিয়ম আক্তার বীথির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অফিস সহকারী নাজমুল হাসানের কথামতো আমি তালিকা ও ১২ লাখ টাকা তার হাতে দিই। কিন্তু তিনি বাকি নামও অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি, আর টাকাও ফেরত দেননি। বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।’
বীথি বলেন, ‘আমি নিয়মকানুন জানতাম না, উনি (নাজমুল) আমায় বলেছেন, তুমি শুধু মহিলাদের আইডি কার্ড আর প্রতি নামে ৬ হাজার টাকা ও কাগজপত্র ঠিক করতে ১৫০০ টাকা এনে দেও, বাকিটা আমি দেখব। কিন্তু পরে আমি নীতিমালার বিষয়টি জানতে পারি। ওনারা সবার কাছ থেকেই ঘুষ নিয়েছেন আর ঘুষের বিনিময়েই নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।’
বীথি বলেন, সুবিধাভোগীদের যে বিকাশ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা দেয়া হয়, ওই নম্বর ও অ্যাকাউন্ট চেক করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’
বীথির মতো আরও একজন পৌর শহরের আমতলারপাড় এলাকার শুক্কুর আলী। তিনি বরগুনা পৌরসভায় পিয়ন পদে চাকরি করেন। শুক্কুর আলী জানান, বরগুনা পৌরসভা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ১০৩ জন মায়ের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেরুন্নাহার মুন্নীর হাতে তিনি সরাসরি জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়েছেন। সেখান থেকে ৬৩ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঞ্চিত বাকি ৪০টি নামের ঘুষের টাকা ফেরত চাইলে এখন তাকে চিনতেই পারছেন না উপপরিচালক মেহেরুন্নাহার মুন্নী।
শুক্কুর আলী নিজের নম্বর থেকে প্রতিবেদকের সামনেই মেহেরুন্নাহার মুন্নীর নম্বরে কল করলে তাকে না চেনার ভান করেন মুন্নী। এর কিছুক্ষণ পরই মেহেরুন্নাহার মুন্নীর অফিস থেকে আরেকজন শুক্কুরকে ফোন দিয়ে অফিসে যেতে বলেন।
শুক্কুর আলী বিষয়টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহিদুল করিম বাবুর কাছে জানান।
জাহিদুল করিম বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। গত দুই-তিন মাস ধরেই শুক্কুর আলী জানাচ্ছেন, মেহেরুন মুন্নীকে তিনি টাকা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি মেহেরুন মুন্নীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একাধিকবার ফোনে কথা বলে অফিসে গিয়েও তার দেখা পাইনি।’
শুক্কুর আরো বলেন, সদরের বুড়িরচর ইউনিয়েনরও অনেকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন মেহেরুন মুন্নী।
শুক্কুরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বুড়িরচর ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামের একাধিক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় ২২ নারীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে অর্থ। তাদের অনেকে তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নারী জানান, মুন্নী ও নাজমুলকে টাকা দিয়ে তারা নাম তালিকায় ওঠাতে চেয়েছেন। কিন্তু টাকা নিলেও ভাতা পাননি তারা। এখন তারা ঘুষের অর্থ ফেরত চান।
এ বিষয়ে বরগুনা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অফিস সহকারী নাজমুল হাসানের সঙ্গে তার কার্যালয়ে কথা হয়। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নাজমুল বলেন, ‘আমি ঘুষ নিয়েছি এর কোনো প্রমাণ নেই।’
এ সময় বীথির সঙ্গে ঘুষের টাকা নিয়ে সালিশ বৈঠকের ভিডিওচিত্র দেখানো হয় তাকে। ওই ভিডিও দেখে তিনি চুপ হয়ে যান এবং প্রতিবেদককে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন।
সালিশ বৈঠকে উপস্থিত বরগুনা সদরের বিআরডিবির (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড) চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি সালিশ বৈঠক করেছিলাম। নাজমুল ভাই টাকা নিয়েছেন স্বীকার করে নাম তালিকাভুক্ত করে দেবেন অথবা টাকা ফেরত দেবেন মর্মে অঙ্গীকার করেন। ওই সালিশের একটি রোয়েদাদও হয়েছিল, যা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।’
বরগুনা পৌর শহরে দীর্ঘদিন ধরে এ প্রকল্প চলে এলেও সংশ্লিষ্ট পৌর মেয়রকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি কিছুই। বরগুনা পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, ‘এই কর্মসূচির সুবিধাভোগী বাছাই ও সহায়তার টাকা দেয়ার সব কাজই মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর করে থাকে। আমাদের তারা অবহিতও করে না। এমন অনিয়মের বিষয়ে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনা জরুরি।’
তবে এমন সব অভিযোগ অস্বীকার করে বরগুনা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেরুন্নাহার মুন্নী দাবি করেন, নীতিমালা মেনেই সুবিধাভোগী বাছাই ও ভাতা দেয়া হচ্ছে। ঘুষ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি ভুক্তভোগীদের দাবি নাকচ করে দেন। অফিস সহকারীর ঘুষ নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তার (নাজমুলের) বিরুদ্ধে কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয়, তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’