আধুনিক বন্দরের কথা উঠলেই হংকং, চীন, সিঙ্গাপুর বন্দরের উদাহরণ দেয়া হয়। তবে এই উদাহরণ দেয়ার দিন মনে হয় শেষ হয়ে আসছে। বছর তিনেকের মধ্যেই হয়তো এসব নামের সঙ্গে যোগ হবে বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বে-টার্মিনাল। কারণ উন্নত দেশের বন্দরে যেসব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এবং যে গভীরতার জাহাজ প্রবেশ করতে পারে, তার প্রায় সব সুবিধা নিয়েই চট্টগ্রামের সাগরপাড়ে গড়ে উঠছে এই বে-টার্মিনাল। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে ৫-৬ গুণ বড় এই বে-টার্মিনাল হলে ১০০ বছরের মধ্যে নতুন করে বন্দর সম্প্রসারণের চিন্তাই করা লাগবে না। অনেক গতি বাড়বে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে, কমবে খরচ। লাভবান হবে ভোক্তারা। আর কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার মানুষের।
সম্প্রতি নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার এই প্রকল্প নিয়ে এসব সম্ভাবনার কথা, আশার কথা শোনান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মাদ ওমর ফারক।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো কর্ণফুলী নদীপাড়ের চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের বৃহত্তম এই বন্দর গড়ে উঠেছে প্রায় সাড়ে ৪০০ একর জমিতে। প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে হিমশিম খেতে হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে। গত কয়েক বছর ধরে গ্রোথ ১২-১৪ শতাংশ। তাই বিছিন্নভাবে প্রায়ই বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে নেয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। কিন্তু বন্দরের কার্যক্রম কর্ণফুলী নদীকেন্দ্রিক হওয়ায় এবং জায়গা সংকটের কারণে আগামীতে হয়তো আর কোনো প্রকল্প নেয়া সম্ভব হবে না।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আরও গতি আনতে বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম ইপিজেডের ঠিক পেছনেই আউটার রিং রোডসংলগ্ন সাগরপাড়ে প্রায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ জায়গায় বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প নিয়েছে, যেটি হবে গভীর সমুদ্রবন্দরের আদলে এক আধুনিক বন্দর।
দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই বেশি দৈর্ঘ্য ও ড্রাফটের (পানির ভেতরে থাকা জাহাজের অংশ) জাহাজ ভিড়তে পারবে বে-টার্মিনালে। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারবাহী বড় বড় জাহাজ ভিড়তে পারে শুধু জোয়ারের সময়। বাকি সময় এসব জাহাজকে অপেক্ষা করতে হয় সাগরের নির্দিষ্ট গভীরতায় বহির্নোঙরে। যেখানে বে-টার্মিনাল থেকে বহির্নোঙরের দূরত্ব এক কিলোমিটার। আর বে-টার্মিনাল রিং রোডঘেঁষা হওয়ায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে থাকবে না কোনো জটও। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচালন ব্যয় অনেক কমবে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্ব বাড়বে বাংলাদেশের।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে এখন সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। বে-টার্মিনাল হলে ১৪ মিটার ড্রাফটের বড় বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২২০০-২৩০০ কনটেইনার ধারণক্ষমতার জাহাজ আসতে পারে। বে-টার্মিনালে ৫-৬ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ আসতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে ৫-৬ গুণ বড় হবে এই বে-টার্মিনাল। এটি নির্মাণ হলে ১০০ বছরের মধ্যে আর নতুন করে বন্দর বাড়ানোর চিন্তা করা লাগবে না আমাদের।’
প্রকল্প এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণের অংশ হিসেবেই বন্দর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগের বিস্তীর্ণ ভূমি ও সাগর ঘেঁষে হচ্ছে বে-টার্মিনাল। এর পূর্ব পাশে আউটার রিং রোড এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের খেজুরতলার বিপরীত থেকে কাট্টলী পর্যন্ত অংশে পলি জমে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চর হয়েছে। এই চরকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে বে-টার্মিনাল। বর্তমানে চরের কিছু এলাকায় বালু ফেলে ভূমি উন্নয়নকাজ চলছে। একটু দূরে দূরে রয়েছে প্রকল্পের সাইনবোর্ড। সেখানে বিদ্যুতের একটি সাবস্টেশনও করা হয়েছে।
বে-টার্মিনালে প্রথম পর্যায়ে তিনটি টার্মিনাল হবে। এর মধ্যে দুটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে অন্যান্য সব সুবিধা ছাড়াও ট্রাক টার্মিনাল ও আলাদা ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ পরিকল্পনায় রয়েছে।
টার্মিনাল তিনটির মধ্যে একটি হবে চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে। আর বাকি দুটি হবে পিপিপি মডেল বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে। তিনটি টার্মিনালই ২০২৪ সালের মধ্যে চালু করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আশা করা হচ্ছে, তিনটি টার্মিনালের মধ্যে মাল্টিপারপাস টার্মিনালের বিনিয়োগ সাড়ে ৮ বছরে এবং কনটেইনার টার্মিনাল দুটির বিনিয়োগ সাড়ে ১১ বছরে উঠে আসবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কারিগরি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। সেই সমীক্ষায় এই বে-টার্মিনাল গড়ে তোলার উপযুক্ত বলে মত দেয়া হয়েছিল। তার পরই বে-টার্মিনালটি নির্মাণে উদ্যোগী হয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বে-টার্মিনালের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রায় ২৫০০ একর জমি প্রয়োজন। এর মধ্যে ৮৭০ একর জমির প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ৮০৩ একর খাসজমি অধিগ্রহণের চূড়ান্ত অনুমোদনও পাওয়া গেছে। বাকি ১৬২৯ একর জমি বে-এরিয়া থেকে রিক্লেইম করা হবে। বে-টার্মিনাল নির্মাণে ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। তবে খাসজমি টোকেন মূল্যে পাওয়ার কারণে জমি অধিগ্রহণ বাবদ অন্তত চার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মাদ ওমর ফারুক বলেন, সরকার চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে, সেখান থেকে এই বে-টার্মিনালের দূরত্ব খুব বেশি না। তাই খুব সহজেই ওই সব অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে পোর্টে মালামাল আনা-নেয়া সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমরা বর্তমানে বছরে ৩০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করি। বে-টার্মিনাল তৈরি হয়ে গেলে সেখানেই আমরা ৪৫ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারব। পরে সেটা আরও বাড়বে। এখান আমরা প্রতিবছর কার্গো এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে সরকারকে ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে থাকি। বে-টার্মিনাল হলে আমরা আরও কয়েক গুণ বেশি রেভিনিউ দিতে পারব।’
প্রকল্পের কার্যক্রম খুব দ্রুত এগোচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব বলেন, ‘২০২৪ সালের মধ্যে এই বে-টার্মিনাল অপারেশনে যেতে পারবে বলে আশা করছি। এটি হবে একটি আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক বন্দর।’
গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘এই বে-টার্মিনাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন দেখেছেন বলেই বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন হচ্ছে। রিং রোড বাস্তবায়নসহ বেশ কিছু উন্নয়নের ফলে পুরো এলাকার চিত্র পাল্টে গেছে। এ রকম বড় বড় স্বপ্ন আগে কখনো কেউ দেখেনি। খুব দ্রুতই এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হবে।’
এর আগে গত ১৯ আগস্ট প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের সময় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ২০২৪ সালে বে-টার্মিনালের অপারেশন শুরু করবে। এর তিনটি টার্মিনালের মধ্যে একটি করবে চট্টগ্রাম বন্দর, বাকি দুটি নির্মিত হবে বিদেশি বিনিয়োগে। দেশের স্বার্থ রক্ষা করে যাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়, তাদের এই দুটি টার্মিনাল করতে দেয়া হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই বে-টার্মিনাল হলে ব্যবসায়ীদের সুবিধা হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ ব্যবসায়ীরা সব সময়ই চান কম খরচে ও কম সময়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে। কিন্তু বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে বড় বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এ কারণে বড় জাহাজ থেকে আলাদা করে ছোট ছোট জাহাজে করে আমাদের পণ্য আনা-নেয়া করতে হয়।
‘ফলে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। তা ছাড়া এই বন্দরে সক্ষমতার চেয়ে চাপ বেশি পড়ে যায়। এ কারণেও কখনও কখনো পণ্য খালাস করতে অনেক দিন সময় লেগে যায়। আবার এই বন্দরে ইচ্ছামতো জাহাজ আসা-যাওয়া করতে পারে না, জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব কারণে আমাদের খরচ বেড়ে যায় ও সময়ও বেশি লাগে। এই বে-টার্মিলান হয়ে গেলে খুব দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে আমরা আমাদানি-রপ্তানি করতে পারব।’