সিভিল এভিয়েশনের চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় আটকে আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট (সিবিডি) প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামার জন্য সুউচ্চ ভবন নির্মাণে সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি প্রয়োজন হয়।
আগামী সপ্তাহে এ অনুমোদনের বিষয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছে রাজউক।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিভিল এভিয়েশনের ক্লিয়ারেন্স পেলে আমরা সিবিডির মাস্টার প্ল্যান চূড়ান্ত করতে পারতাম, কিন্তু আমরা এখনও সেটা পাইনি।
‘আমরা তাদের কাছ থেকে ভবনের উচ্চতার বিষয়ে মতামত চেয়েছি, যা এখনও তারা কিছু বলছে না। আমরা তিনটি আইকনিক ভবন করতে চাই। এর প্রধানটি হবে ১৪২ তলা। একটি ৭১ ও অপরটি হবে ৫২ তলার। এখানে মোট ভবন হবে ৫২টি। আমরা এখনও এ টার্গেটেই আছি। আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে সিভিল এভিয়েশন কতটা পর্যন্ত অ্যালাও করে।’
রাজউক চেয়ারম্যন বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে আমরা একটা বড় বৈঠক ডেকেছি। সেখানে চার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকবেন। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সিভিল এভিয়েশনের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। এখানে আমাদের প্রস্তাবিত উচ্চতা অনুমোদিত হলে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা মাস্টার প্ল্যান চূড়ান্ত করে ফেলব।
‘আমাদের ১১১ তলা করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা ১৪২ তলা ভবনের টার্গেট ছাড়িনি। আমরা এটাই করতে চাই। এখন দেখি সিভিল এভিয়েশন কতটা অনুমোদন দেয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কোম্পানি নিয়োগ করেছি। তারা রাজউকের তহবিলে কিছু টাকাও জমা দিয়েছে। তারা ম্যানেজেরিয়াল ভবনও নির্মাণ করছে। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গেও চুক্তি হয়েছে। মাস্টার প্ল্যান না হওয়া পর্যন্ত তারা কাজ শুরু করতে পারছে না।’
শহরের যে অংশে প্রধান বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ গড়ে ওঠে, তাকে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকা বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট বলে। যেহেতু এই কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকাকে কেন্দ্র করে শহরের বিভিন্ন মানুষের সমাগম ঘটে, এ অংশের সঙ্গে সব স্থানের ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকে।
সিবিডির বৈশিষ্ট্য হলো উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। এখানে সরকারি-বেসরকারি রুটে বাস, ট্রাম, মেট্রোরেল ও অন্যান্য গাড়ির সংযোগ থাকে এবং সকাল ও সন্ধ্যায় রাস্তায় বেশিসংখ্যক গাড়ির উপস্থিতি দেখা যায়। তবে রাতে থাকে নীরব, সুনসান।
সিবিডির স্বপ্ন
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬ সালের ২ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের সময় সিবিডি সম্পর্কে বলেন, ‘আমি আমার একটি স্বপ্নের কথা বলতে চাই। আমার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক ও জনবান্ধব একটি প্রকল্প সম্পর্কে সবাইকে বলব। আপনারা জানেন, পূর্বাচল ও এর নিকটস্থ এলাকা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র মহানগর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
‘এ মহানগরে পিপিপির আদলে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি। এর মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার, একটি আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স এবং ১৪২ তলা আইকনিক টাওয়ার স্থাপন করা হবে।’
সে সময় ঢাকায় ১৪২ তলার এই আইকনিক টাওয়ার নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
ভবন নির্মাণে প্রথমে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও কেপিসি গ্রুপের মালিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কালী প্রদীপ চৌধুরী। অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও কালী প্রদীপ চৌধুরীর উপস্থিতিতে ২০১৬ সালের ১২ জুন এ টাওয়ার নির্মাণের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের তারিখ চূড়ান্ত হয়।
কিন্তু জমির দাম সেই সময়ের বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয় (প্রতি একর ২১ কোটি টাকা)। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও তৈরি হয়। এ কারণে চুক্তি করতে এলেও চুক্তি না করে ফিরে যান কেপিসি গ্রুপ চেয়ারম্যান।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে কেপিসি গ্রুপের চেয়ারম্যান কালী প্রদীপ চৌধুরী ভবনটি নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী মুহিতের সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করেন। পরে কেপিসি গ্রুপের পক্ষে অর্থমন্ত্রী ১০০ একর জায়গার ওপর মূল ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় ওই বছরের নভেম্বর মাসে পূর্বাচলের সিবিডি অংশে ওই জায়গা দিতে রাজি হয়।
কনসোর্টিয়াম চুক্তি
নানা জটিলতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর সিবিডি নির্মাণে ৮০০ কোটি বা ৮ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করে ডেভেলপার কোম্পানি ‘কনসোর্টিয়াম অব পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংস’ ও জাপানি প্রতিষ্ঠান ‘কাজিমা করপোরেশন’।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে রাজউক ও ডেভেলপার কোম্পানি সূত্র জানায়, সিবিডি নামের নতুন এ বাণিজ্যিক শহরটি সাত বছরে শতাধিক একর জমির ওপর তৈরি করা হবে।
সিবিডিতে ৪৬৫ মিটার উচ্চতার ১৪২ তলা বিশিষ্ট আইকনিক লিগ্যাসি টাওয়ার, ৭১ তলা বিশিষ্ট স্বাধীনতা টাওয়ার ও ৫২ তলা বিশিষ্ট ভাষা টাওয়ারসহ ৪১টি গগণচুম্বী ভবন থাকবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এসব ভবনে ৩ কোটি ৮০ লাখ বর্গফুট জায়গা পাওয়া যাবে।
রাজউক বলছে, সিবিডির বাকি ৩৮টি ভবনের প্রত্যেকটির উচ্চতা ৪০ তলার সমান হবে। বাণিজ্যিক শহরের এ পরিকল্পনায় একটি বড় সম্মেলন সেন্টারও থাকবে।
২০১৮ সালে এক উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান পাওয়ারপ্যাক ও জাপানি প্রতিষ্ঠান কাজিমা যৌথভাবে রাজউকের কাছ থেকে এ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পায়। পূর্বাচলের ১৯ নম্বর সেক্টরে ১১৪ একর জমির ওপর এ কাজ করবেন তারা।
প্রকল্পের কাজে নেতৃত্ব দেবে পাওয়ারপ্যাক। আর কারিগরি অংশীদার হিসেবে জাপানের কাজিমা তাতে সহায়তা করবে।
নিলামের শর্ত অনুসারে মোট ভূমির মূল্যের ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এরই মধ্যে রাজউককে পরিশোধ করেছে পাওয়ারপ্যাক-কাজিমা কনসোর্টিয়াম।
পাওয়ারপ্যাক কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের দায়িত্ব পাওয়ার পরই তারা নির্মাণকারী ঠিকাদার হিসেবে চীনা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়না ইন্টারন্যাশন্যাল গ্রুপ লিমিটেড এবং প্রকল্পের নকশার জন্য বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ প্রকৌশল কোম্পানি দক্ষিণ কোরিয়ার হিরিম আর্কিটেক্ট অ্যান্ড প্ল্যানার্স কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
এ ছাড়া নির্মাণ ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জন্য ফরাসি প্রতিষ্ঠান আরকেটাইপ কনস্ট্রাকশন হোল্ডিংস লিমিটেড, মাটি পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ট্রাফিক ও পরিবেশের প্রভাব মূল্যায়নের জন্য প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপারকে (পিডব্লিউসি) নিযুক্ত করা হয়েছে।
বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রাইস ওয়াটারহাউজ, ইন্ডিয়াকেও নিযুক্ত করেছে পাওয়ারপ্যাক।
ইপসার সঙ্গে চুক্তি
২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট প্রকল্পের একাংশের অর্থায়নসহ উন্নয়নে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘চায়না এনার্জি কোম্পানি লিমিটেড’ যুক্ত হয়েছে।
বেইজিংয়ে চায়না এনার্জির প্রধান কার্যালয়ে পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংস ও কাজিমা করপোরেশন কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ৩৬০ কোটি ডলারের প্রকৌশল, ক্রয় ও নির্মাণ (ইপিসি) চুক্তি হয়।
বাংলাদেশি মুদ্রায় চুক্তিমূল্য ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সব থেকে বড় অঙ্কের ইপিসি চুক্তি। পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংস ও কাজিমা করপোরেশন কনসোর্টিয়ামের পক্ষে পাওয়ারপ্যাক হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রন হক সিকদার এবং চায়না এনার্জি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান ঝাং হংমিং এই ইপিসি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ট্রাই টাওয়ার
সিবিডির প্রধান তিনটি ভবনকে বলা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু ট্রাই টাওয়ার’। রাজউক মনে করে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ১৪২ তলাবিশিষ্ট আইকনিক লিগ্যাসি টাওয়ারসহ মোট ৪২টি আকাশচুম্বী স্থাপনা এখানে তৈরি হবে। আইকনিক লিগ্যাসি টাওয়ারটি হবে বিশ্বের পঞ্চম উঁচু ভবন। এর ৯৬ তলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রা সম্পর্কিত একটি জাদুঘর থাকবে। আর ৭১ তলাবিশিষ্ট ভবনটি হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে। এ ছাড়া ৫২ তলা ভবনটি তুলে ধরা হবে ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য ত্যাগ ও মহিমার নিদর্শন হিসেবে।
এই তিনটি ভবন বা টাওয়ারের নাম হবে ‘বঙ্গবন্ধু ট্রাই টাওয়ার’। এগুলো তিনটি (ল্যাঙ্গুয়েজ, লিবারেশন ও লিগ্যাসি) প্রতীক বহন করবে।
১১৪ একর জমির ওপর পুরো প্রকল্পে একটি আধুনিক ও উচ্চ প্রযুক্তির সুরক্ষাপ্রাচীর স্থাপন করা হবে।
গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পের ইতোমধ্যেই প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সংস্থান হয়েছে। বাকি অর্থ সংগ্রহের কাজ করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রথম দুই বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার নির্মাণ সামগ্রী কেনা হবে, যা দেশের অর্থনীতি ও নির্মাণশিল্পে বড় ভূমিকা রাখবে।
এরই মধ্যে প্রকল্পের মাটি পরীক্ষা, যানবাহন ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমীক্ষা, প্রকল্পের খসড়া মাস্টারপ্ল্যান, ডিজাইন রাজউকে জমা দিয়েছে প্রকল্প পরিচালক। একই সঙ্গে স্মার্ট ও অত্যাধুনিক নির্মাণ শৈলীর আইকনিক টাওয়ারের ডিজাইনের জন্য রাজউক একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। পরিবেশবান্ধব এ ভবনটির সারা দেয়ালে সর্বাধুনিক সোলার গ্লাস লাগানো হবে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটির জন্য ব্যবহার করা হবে মাটির নিচের লাইনের ডাক্ট ব্যবস্থা।
গ্রিন ভবনগুলোর ওয়ালে চীনের গ্রেট ওয়ালের আদলে নির্মাণ করা হবে ওয়াকওয়ে। অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য পরিবেশবান্ধব ইলেকট্রিক বাস ও আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াকওয়ে থাকবে। ভবনের স্থাপত্য নকশা তৈরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত হেরিম আর্কিটেক্ট।