বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ক্লিন ফিড পেতে অন্তত ছয় মাস

  •    
  • ৭ অক্টোবর, ২০২১ ১৯:১৫

ওয়ান অ্যালায়েন্স লিমিটেডের হেড অব ডিস্ট্রিবিউশন মো. সাইফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্লিন ফিড দিতে হলে দেশের সকল অপারেটরকে সেট-টপ বক্স সরবরাহ করতে হবে। নতুন করে স্যাটেলাইটে চ্যানেল আপ করতে হবে, নতুন ফিড দিতে হবে। রাতারাতি এটা সম্ভব না। এটা এখন থেকে শুরু করলেও কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে।’

ছয় দিন ধরে ক্লিন ফিড (বিজ্ঞাপনমুক্ত টেলিভিশন কনটেন্ট) জটিলতায় বেশ কিছু বিদেশি চ্যানেল দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দর্শকরা। সরকারও ক্লিন ফিডের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে অনড়। সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে নানা অংশীজনের।

১৫ বছর আগেই এ ক্ষেত্রে আইন থাকলেও কেন এ দেশে ক্লিন ফিডের বাস্তবায়ন হচ্ছে না? ক্লিন ফিড দিতে ব্রডকাস্ট কোম্পানিগুলোর বাধা কোথায়?

বিজ্ঞাপনবিহীন টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে ক্লিন ফিড। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনমুক্তভাবে সম্প্রচার হয়। প্রতিবেশী সব দেশ এমনকি নেপালেও বিদেশি চ্যানেলগুলো ক্লিন ফিড সম্প্রচার করে।

এ দেশে ২০০৬ সালের কেব্‌ল নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইনেও বিদেশি চ্যানেলগুলোর ক্লিন ফিড সম্প্রচারের কথা বলা আছে। কিন্তু এটি কার্যকর করার উদ্যোগ এর আগে নেয়া হলেও তা সম্ভব হয়নি। এবার সরকার তা কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর।

ক্লিন ফিড করবে কে?

কোনো টেলিভিশন চ্যানেলকে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে সম্প্রচার তিনটি পক্ষ থাকে: ব্রডকাস্ট কোম্পানি, ডিস্ট্রিবিউটর ও লোকাল কেব্‌ল অপারেটর। সরকার এখানে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে। তবে লোকাল কেব্‌ল অপারেটররা যেহেতু সংখ্যায় অনেক, তাদের গ্রাহকসংখ্যাও সীমিত ও এলাকাভিত্তিক, তাই তারা ক্লিন ফিড করতে চাইলেও পারে না। এ ক্ষেত্রে দায় ব্রডকাস্টার কোম্পানি ও লোকাল ডিস্ট্রিবিউটরের।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সম্প্রতি বলেন, ‘যেসব চ্যানেল ক্লিন ফিড পাঠায় না, এ দেশে তাদের এজেন্ট আছে। এই দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট চ্যানেল ও এজেন্টদের। এটি কেব্‌ল অপারেটরদের দায়িত্ব নয়।’

তবে লোকাল ডিস্ট্রিবিউটররা বলছেন, ক্লিন ফিড বাস্তবায়ন তাদের পক্ষে সম্ভব না। এটা বাস্তবায়ন করতে পারে শুধু ব্রডকাস্টাররা। তারা চ্যানেলগুলো আপলিংক করার সময় ক্লিন ফিড করে আপ করতে পারে। কেব্‌ল অপারেটররা সেগুলো তাদের রিসিভারে ক্লিন ফিডসহ রিসিভ করবে। তাই এ সমস্যার সমাধান ব্রডকাস্টারের কাছেই।

সমস্যা বিনিয়োগ ও ডিজিটালাইজেশনে

বাংলাদেশের যে গ্রাহকসংখ্যা রয়েছে, তার জন্য ক্লিন ফিড পাঠানো ও রিসিভ করার পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আলাদা স্যাটেলাইট প্রয়োজন। এ ছাড়া কেব্‌ল অপারেটরদের বর্তমান রিসিভারগুলোও পরিবর্তন করতে হবে। সারা দেশে বিপুলসংখ্যক রিসিভার পরিবর্তন করা সময়সাপেক্ষ। আবার এ জন্য পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। সেট-টপ বক্স বসাতে হবে গ্রাহকপর্যায়ে।

এখানে ব্রডকাস্টারদের আয়-ব্যয়ের প্রশ্নও রয়েছে। ডিস্ট্রিবিউটররা বলছেন, ক্লিন ফিড দিতে ব্রডকাস্টারদের বাড়তি অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু তারা এখনই তা চান না। কারণ দেশের প্রকৃত কেব্‌ল টিভি গ্রাহক কত, তা কারও জানা নেই। এ সংখ্যা ১ থেকে ৩ কোটি হতে পারে।

চ্যানেল ডিস্ট্রিবিউশনে চার প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশে মূলত চারটি প্রতিষ্ঠান বিদেশি চ্যানেলগুলোর ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করে। তারাই ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক বা দুবাইভিত্তিক শতাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের বাংলাদেশ প্রতিনিধি। তাদের মাধ্যমেই এ দেশে বিদেশি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার হয়। চারটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে: ওয়ান অ্যালায়েন্স লিমিটেড, যাদুভিশন মিডিয়া, নেশনওয়াইড মিডিয়া এবং মিডিয়া কেয়ার।

সরকার থেকে শুরু করে কেব্‌ল অপারেটর এমনকি দেশি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকরাও বলছেন, ক্লিন ফিড করার দায়ত্বি এ চার প্রতিষ্ঠানেরই। তারাই তাদের মূল ব্রডকাস্টারের কাছ থেকে ক্লিন ফিড আদায় করে নেবে।

কী কী পদক্ষেপ, কত দিন লাগবে

ওয়ান অ্যালায়েন্স লিমিটেডের হেড অব ডিস্ট্রিবিউশন মো. সাইফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ব্রডকাস্টারদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তারা বলছে, ক্লিন ফিড বাংলাদেশে টেকনিক্যালি অবশ্যই সম্ভব। তবে এটাতে যে পরিমাণ ইনভেস্ট করতে হবে, তার তুলনায় রিটার্ন কম পাওয়া যাবে। তারপরও ওরা চেষ্টা করছে আমাদের ক্লিন ফিড দিতে।

‘তবে সেটা এক দিনে সম্ভব না। এর জন্য সময় প্রয়োজন। বাংলাদেশে যতগুলো অপারেটর আছে, প্রত্যেক অপারেটরকে সেট-টপ বক্স সাপ্লাই করতে হবে। নতুন করে স্যাটেলাইটে চ্যানেল আপ করতে হবে, নতুন ফিড দিতে হবে। এই কারিগরি প্রক্রিয়াগুলো সম্পাদনের চেষ্টা করছে তারা। তবে সব অপারেটর এখন তা দিতে পারবে না। তাই রাতারাতি এটা সম্ভব না। এটা এখন থেকে শুরু করলেও কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘লোকাল ডিস্ট্রিবিউটররা এটা চাইলেও সম্ভব না। টেকনিক্যাল কোনো বিষয়ই ডিস্ট্রিবিউটরদের হাতে নাই। এর পুরোটা ব্রডকাস্টারের হাতে। তাদের কাছে বিভিন্ন কোড রয়েছে। এখানে ব্রডকাস্টার না চাইলে তা ডিস্ট্রিবিউটরদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ জন্য যদি ডিজিটাইজেশন হয়, তাহলে গ্রাহক সংযোগের একচুয়াল ফিগার পাওয়া যেত।

‘বাংলাদেশে মনে করা হয় ২ থেকে ৩ কোটি গ্রাহক রয়েছে। সবার কাছ থেকে যদি অপারেটররা কানেকশন ফি পেত, সেখান থেকে আমরা পেতাম, আমাদের কাছ থেকে ডিস্ট্রিবিউটররা পেত। এটা হিউজ মানি। তা হলে ব্রডকাস্টারের পক্ষে সম্ভব ছিল, তাদের গ্রাহকপ্রতি খরচ কমে আসত। তারা আরও দ্রুত সাড়া দিত।’

একই মত কেব্‌ল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) সভাপতি আনোয়ার পারভেজেরও। তিনি বলেন, ‘এখন অ্যানালগ সংযোগে ব্রডকাস্টার, ডিস্ট্রিবিউটর ও অপারেটরদের আয় অনেক কম। ডিজিটাল হলেই প্রকৃত কেব্‌ল সংযোগসংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। তখন চ্যানেলগুলোর আয়ও বাড়বে। তারা যখন দেখবে দেশের কোটি গ্রাহকের কাছ থেকে তারা বড় অঙ্কের আয় করছে, তখন তারা বিনিয়োগ করে এ দেশে ক্লিন ফিড পাঠাতে বাধ্য হবে।’

তবে কোয়াব নেতা সৈয়দ মোশারফ আলী বলেন, ‘চারটি মাত্র ডিস্ট্রিবিউটর, তারা তো চ্যানেলগুলোর প্রতিনিধি। ডিস্ট্রিবিউটরদের সরকার বলে দিক, এত দিনের মধ্যে ক্লিন ফিড দিতে হবে। তারাই তো দায় নেবে। এখানে কেব্‌ল অপারেটরদের কোনো দায় না থাকলেও তারাই বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে।’

দেশি চ্যানেলের লাভের সুযোগ

ক্লিন ফিড হলে দেশি টেলিভিশন চ্যানেল শিল্পের আর্থিক সংকট কমবে। টিভি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সম্প্রচারকর্মীরাও এর সুফল পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশি চ্যানেলগুলো চাইছে, এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকুক। ক্লিন ফিডের জন্য ডিজিটাল সংযোগও চায় তারা। এতে অন্যান্য দেশের মতো প্রত্যেক গ্রাহক সংযোগে নির্দিষ্ট হারে অর্থও পাওয়া হবে।

দেশি চ্যানেলগুলোর মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো বলছে, এতদিন ধরে বিদেশি চ্যানেলগুলো তাদের মূল ব্রডকাস্টারের মাধ্যমে টিভিতে বিজ্ঞাপন দিত, তা এ দেশে প্রচারও হতো। ফলে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রাহকের কাছে এমনিতেই বিজ্ঞাপন পৌঁছে যেত। ফলে এসব মাল্টিন্যাশনাল বড় কোম্পানিগুলো দেশীয় চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন দিত না বললেই চলে। এসব বিজ্ঞাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকার কোনো করও পেত না।

বিজ্ঞাপন পাচার বা অ্যাড ওভারফ্লোয়ের মাধ্যমে বছরে দেশের ১২০০ কোটি টাকা খোয়া যাচ্ছে বলে দাবি অ্যাটকোর। তারা বলছে, এখান থেকে সরকারও কর বাবদ অন্তত ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব পেত, যা এখন হারাতে হচ্ছে।

অ্যাটকোর সিনিয়র সহসভাপতি ও বেসরকারি একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু বলছেন, ‘আইন অনুযায়ী বিদেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগই নেই। কিন্তু এতদিন তারা সুযোগ পেয়েছে। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এ বিশাল বিজ্ঞাপন যদি দেশি চানেলে প্রচার হতো, একই সঙ্গে যদি যে তিন-চার কোটি গ্রাহক রয়েছে, তাদের কাছ থেকে যদি এক টাকা করেও চ্যানেলগুলো পেত, তাও অনেক টাকা। তাহলে দেশি চ্যানেলগুলো আর অর্থসংকটে থাকত না। অনুষ্ঠানের মান আরও ভালো করা যেত। পৃথিবীর সব দেশে এ আইন মানা হচ্ছে।’

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদও সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্লিন ফিড না চালানোয় ক্ষতি হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা, যা দেশে বিনিয়োগ হতো। আইন ভঙ্গ করে বিদেশি চ্যানেলে যদি বিজ্ঞাপন না দেখানো হতো, তবে দেশের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি লাভবান হতো। ক্লিন ফিড না চলার কারণে দেশের অর্থনীতি, শিল্পী, শিল্প, সংস্কৃতি ও মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে কারণেই আমরা এ পদক্ষেপ নিয়েছি।’

ক্লিন ফিড (বিজ্ঞাপনমুক্ত) ছাড়া বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারের ওপর সরকার বিধিনিষেধ জারির পর ১ অক্টোবর থেকে সব বিদেশি চ্যানেল প্রদর্শন বন্ধ করে দেয় কেব্‌ল অপারেটররা। পরে সরকারের নির্দেশনায় সিএনএন, বিবিসিসহ ২৪টি চ্যানেল সম্প্রচার শুরু করে। ক্লিন ফিড পুরোপুরি কার্যকর করতে আরও সময় চেয়েছে কেব্‌ল অপারেটারা।

কোয়াব সভাপতি আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘এ খাত ডিজিটাইজড করার পরই এমন সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের ব্যবসা টিকে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি পুরো সহযোগিতা ও আর্থিক সুবিধা দেয়, তাহলে আগামী এক বছরেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’

অপারেটরদের একাংশের নেতা সৈয়দ মোশারফ আলী বলেন, ‘আমরাও ক্লিন ফিড চ্যানেল চাই। গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করি আমরা কেব্‌ল অপারেটররা। এখন মাসের শুরু, অনেক চ্যানেলই বন্ধ, গ্রাহক আমাদের ঠিকমতো টাকাও দিচ্ছে না। তবে যতদিন ক্লিন ফিড না হয়, ততদিন চলতে দেয়ার দাবি করছি, যাতে দর্শকরা বঞ্চিত না হয়। আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি।

তবে বিদেশি চ্যানেলের ক্লিন ফিড নিশ্চিত করতে কেব্‌ল অপারেটররা আরও সময় চাইলেও তাতে একমত নন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহ্‌মুদ। সচিবালয়ে বুধবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বিদেশি চ্যানেলগুলো যেদিন থেকে ক্লিন ফিড পাঠাবে, সেদিন থেকে তারা সম্প্রচার করতে পারবে। অনেক চ্যানেল এরই মধ্যে ক্লিন ফিড প্রচার শুরু করেছে। বাকিগুলোও শিগগিরই করবে।’

এ বিভাগের আরো খবর