বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভে রোগীর বিড়ম্বনা

  •    
  • ৭ অক্টোবর, ২০২১ ১০:২৮

হাসপাতালে আসা শিরিন বিবি বলেন, ‘আমি ডাক্তার দেখে বের হতেই আমার হাত থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলছে। বিব্রতকর পরিস্থিতি... হাসপাতালে যেসব রোগী আসেন তাদের মধ্যে অনেক গুরুতর অসুস্থ রোগী থাকে। টেনশন থাকে। এমন পরিস্থিতিতে তারা কেন এমনভাবে বিব্রত করে।’

নওগাঁর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন ৫০ বছরের আব্দুস ছাত্তার। চেম্বার থেকে বের হওয়া মাত্রই তাকে ঘিরে ধরলেন পাঁচ থেকে ছয় জন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ (এমআর)। তার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন প্রেসক্রিপশন। চিকিৎসক তাকে কী কী ওষুধ লিখে দিলেন সেগুলো দেখতে থাকেন, ছবিও তুলে নেন কেউ কেউ। প্রায় দু-তিন মিনিট ধরে তাদের এই কাজ চলে। ওদিকে বৃদ্ধ আব্দুস ছাত্তার কাহিল।

নিউজবাংলার এই প্রতিবেদককে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে আব্দুস ছাত্তার বলেন, ‘আরে বাবা হামাক (আমাকে) যেভাবে চারদিক দিয়া ঘিরা ধরল, প্রথমে মনে করছিনু (করেছি) পুলিশের লোক। ভয় পাইয়া কছি (বলেছি) “কী হছে (হয়েছে) বাবা, হামাক এভাবে ঘিরা ধরলিন ক্যা (ঘিরে ধরলেন কেন)।” তখন কলো (বলল), ‌'চিকিৎসা নির্দেশিকা বইটি দেন দেখব।' দেয়ার আগেই হাতোত থ্যাকা লিয়া (হাত থেকে নিয়ে) ছবি তুলল।

‘হামি (আমি) একজন বয়স্ক রোগী একাই আচ্ছি (আসছি)। এমন করা হেনস্তা করার কোনো মানে হয় কও তো।’

ওষুধ কোম্পানিগুলোর এমআরদের এমন হেনস্তা ও বিড়ম্বনার অভিযোগ এই হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসা প্রায় সব রোগীর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এ সমস্যার সুরাহা করা হবে, তবে একটু সময় লাগবে।

নওগাঁ জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসার জায়গা এই হাসপাতাল। প্রতিদিন সেখানে চিকিৎসা নেয় শ শ মানুষ। এমআরদের দৌরাত্ম সেখানে দিন দিন বাড়ছে বলে অভিযোগ রোগী ও স্বজনদের।

হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ৮ মাসের সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন দেবাশিষ সাহা। তিনি বলেন, ‘তিন দিন থেকে আমার বাচ্চা এখানে কেবিনে ভর্তি। আজ সকালে হুট করে দুই রিপ্রেজেন্টেটিভ কেবিনে ঢুকে প্রেসক্রিপশন চাইল। সেটা দিয়ে কী করবে জানতে চাইলে তারা বলেন, একটু দেখবেন। আমি দেয়ার আগেই তারা টেবিলে রাখা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি তুলতে থাকেন।

‘এভাবে যে কেউ কেবিনে ঢুকে পরার কোনো মানে হয় না। এটা কতটুকু উচিত হয়েছে তাদের?’

হাসপাতালের সেবা নিতে আসা শিরিন বিবি বলেন, ‘আমি ডাক্তার দেখে বের হতেই আমার হাত থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলছে। বিব্রতকর পরিস্থিতি। কেমন আচরণ এগুলো?

‘হাসপাতালে সেসব রোগী আসেন তাদের মধ্যে অনেক গুরুতর অসুস্থ রোগী থাকে। টেনশন থাকে। এমন পরিস্থিতিতে তারা কেন এমনভাবে বিব্রত করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। প্রতিদিনই হাসপাতালে তারা ভিড় জমায়। কেন যে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, বুঝি না। হয়তো ডাক্তারদের সঙ্গে রিপ্রেজেন্টেটিভদের যোগাযোগ আছে সুবিধা নেয়ার।’

এমআররা কী দেখেন প্রেসক্রিপশনে?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক এমআর বলেন, ‘আসলে আমরা সেলস বিভাগে কাজ করি। নানা সময় চিকিৎসকদের নানা ধরনের সুবিধা ও উপহার দিয়ে থাকি। আমাদের কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখলে বিশেষ উপহারের ব্যবস্থা করে থাকি চিকিৎসকদের জন্য।

‘আমরা হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকি চিকিৎসকরা আমাদের ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখছেন কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা রোগীদের দাঁড় করিয়ে চিকিৎসাপত্র যাচাই করি। এটা তো চিকিৎসকরাও জানেন। ঠিক-বেঠিক হিসাব করলে আমার এ পেশায় কাজ করতে পারব? সবাইকে ম্যানেজ করেই তো চলি আমরা। তাই আপনি আমাদের এগুলো তুলে না ধরলেই ভালো হবে ভাইয়া।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে আরেক এমআর বলেন, ‘আমার মাসিক একটি টার্গেট থাকে, সেটা ফিলাপ করতে হয়। কোনো মাসে দুই লাখ, কোনো মাসে তিন লাখ টাকার ওষুধ বিক্রি করতে হবে আমার ভাগে পড়া এরিয়ায়।

‘আমি শহরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের কাছে যাই। ডাক্তাররা রোগীদের প্রেসক্রিপশনে কী লিখলেন তার ছবি তুলে রাখি। যদি আমাদের কোম্পানির ওষুধের নাম লেখা হয় দিন শেষে সেটা নোট করে জেলায় যিনি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে আছেন তাকে অবগত করা হয়। এভাবে মাস শেষে আমাদের কোম্পানির কত টাকার ওষুধ শহরের বিভিন্ন দোকান থেকে বিক্রি হলো, সে হিসাব করা হয়।’

এ কাজে কী কোনো কমিশন মেলে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বেশি ওষুধ সেল হলে আমার কোম্পানি থেকে বাড়তি কোনো কমিশন দেয়া হয় না আমাকে। তবে কিছু কিছু কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের দেয়া হয় কাজের ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে। আমি যা পাই সেটা মাসের স্যালারি।

‘যদি ভালো ওষুধ সেল করতে না পারি তবে জবাবদিহি করতে হয়। অনেক সময় অনেক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরিও চলে যায় কাজ ভালো না করতে পারলে।’

এসব বিষয় নিয়ে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নওগাঁর রিজিওন্যাল ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার।

তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা রিপ্রেজেন্টেটিভ আছেন, তাদের রোগীর অনুমতি ছাড়া প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে দেখতে নিষেধ করা আছে।

‘রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাজের অংশ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ওষুধের দোকান ভিজিট করা। যদি কেউ প্রেসক্রিপশন না দেখাতে চান তবে জোর করা যাবে না।’

জোর করে প্রেসক্রিপশন দেখার নির্দেশ দেয়া হয় না বলে জানিয়েছেন ওরিয়ন ফার্মা লিমিটেড নওগাঁর সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজার শাহিন কাদেরও।

তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনে কী ধরনের প্রোফাইল করে থাকে, কী ধরনের ওষুধ লিখে থাকে, সেই ধারণা নেয়ার জন্য প্রেসক্রিপশন চেক করা হয়। তা ছাড়া একেক ওষুধ কোম্পানির মোটিভ একেক রকম হয়ে থাকে। আমরা ডাক্তারদের নিজ নিজ কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য বলি না। রিপ্রেজেন্টেটিভরা অনেক সময় ডাক্তারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান পরিচিত হতে। এর বাহিরে কিছু নয়। আর যদি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করে, তবে আমাদের কোনো রিপ্রেজেন্টেটিভ হাসপাতালে যাবে না।’

যা বলছেন চিকিৎসকরা

জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা জান্নাতুন নাঈম বলেন, ‘প্রতিদিন দেড় শ থেকে দুই শ রোগী দেখি। এ সময় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের রিপ্রেজেন্টেটিভদের সঙ্গে কথা বলার সময় কই। আমাদের সঙ্গে রিপ্রেজেন্টেটিভদের কোনো যোগাযোগ নেই। রোগীর জন্য যে ওষুধ প্রয়োজন, সেটাই প্রেসক্রিপশনে লেখা হয়।’

হাসপাতালের সহকারী সার্জন মাকসুদুল হক বলেন, ‘আমরা আউটডোরে রোগী দেখার পর রোগীদের যেসব ওষুধ প্রয়োজন, সে অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন করে দিই। এর বাইরে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের রিপ্রেজেন্টেটিভদের চাহিদামতো কোনো ধরনের ওষুধের নাম লেখা হয় না। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটি সঠিক নয়।’

জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ইবনে ইমাম বলেন, ‘কোনো চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করে ওষুধের নাম লিখলে রোগীর স্বাস্থ্য বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সব কোম্পানির ওষুধের মান এক রকম না। এ ক্ষেত্রে রোগীর জন্য যেমন ওষুধ দরকার, চিকিৎসকের ঠিক তেমন ওষুধই প্রেসক্রাইব করা উচিত।

‘রিপ্রেজেন্টেটিভদের মন জোগাতে ওষুধ লেখার প্রবণতা অনেক চিকিৎসকের রয়েছে, তা সত্যি। যা খুবই দুঃখজনক। আমরা প্রতিদিনই তাদের নিষেধ করে থাকি যে হাসপাতাল চত্বরে যেন রিপ্রেজেন্টেটিভরা প্রবেশ না করে। তবুও তারা কথা শোনে না। চেষ্টা করছি যাতে তারা হাসপাতালের ভেতরে না আসেন। তবে এ সমস্যার সুরহা করতে একটু সময় লাগবে।’

এ বিভাগের আরো খবর