ফাঁসিতে ঝুলতে হবে, দুই বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছে আপিল বিভাগ। মৃত্যু পরোয়ানাও সোয়া এক বছর আগে শুনেছেন একাত্তরের খুনি বাহিনী আলবদরের রংপুরের প্রধান এ টি এম আজহারুল ইসলাম।
তবে সাজা কার্যকরের প্রক্রিয়া আটকে গেছে করোনার কারণে।
আপিল বিভাগের রায় পর্যালোচনা বা রিভিউয়ের যে আবেদন করা হয়েছে, তার ওপর শুনানিই হচ্ছে না। প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তিনি ভার্চুয়াল আদালতে এই আবেদন শুনবেন না। তবে আপিল বিভাগ এখনও সশরীরে বসছে না পুরোপুরি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের নিজেকে রক্ষায় আর দুটি আইনি সুযোগ রয়েছে। এর একটি রিভিউ এবং অন্যটি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবরই আপিল বিভাগ জানিয়ে দেয় মৃত্যুদণ্ডই এটিএম আজহারের সাজা। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ প্রকাশ হয় পূর্ণাঙ্গ রায়। ওই দিনই রায়ের কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
১৬ মার্চ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। কাশিমপুর কারাগারে বন্দি এটিএম আজহারুল ইসলামকে সে পরোয়ানা পড়েও শোনানো হয়।
১৯ জুলাই আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন দাখিল করেন আজহারের আইনজীবীরা। এতে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়।
২০২০ সালের ২০ জুলাই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চে রিভিউ আবেদন শুনানির আবেদন করা হয়, কিন্তু করোনার কারণে সেই শুনানি আর হয়নি।
তখন প্রধান বিচারপতি বলে দেন করোনা কমে আসলে নিয়মিত আপিল বেঞ্চ চালু হলে রিভিউ আবেদন শুনবেন।
ওই বছরের শেষ দিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে এলেও গত মার্চ থেকে তা আবার বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে এপ্রিলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে লকডাউনে যায় দেশ। জুলাইয়ে আরও কঠোর বিধিনিষেধে শুরু হয় শাটডাউন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণের আগেই দেশ আবার সচল হতে শুরু করে। হাইকোর্টে সশরীরে শুনানি শুরু হলেও আপিল বিভাগ এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কিছু বেঞ্চে এখনও শুনানি হচ্ছে ভার্চুয়াল। আর এর সুবিধা পাচ্ছেন জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধী নেতা আজহার।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুরের বদরগঞ্জ থানার মোকসেদপুর গ্রামে গুলি চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা, তৃতীয় অভিযোগে বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিলের আশেপাশের গ্রামে এক হাজার চারশর বেশি হিন্দু গ্রামবাসীকে গুলি চালিয়ে হত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকার পর রিভিউয়ে তা পাল্টে যাবে, এমন সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। রিভিউয়ে রায় পাল্টানোর উদাহরণ নেই বললেই চলে। রায়ে বড় ধরনের ভ্রান্তি থাকলে সাধারণত রিভিউয়ে তা পরিবর্তন নয়।
এর আগে যাদের সাজা হয়েছে, তাদের কারও সাজাই রিভিউ আবেদনে পাল্টায়নি। আসামিদের আবেদনে যেমন আদালত সাড়া দেয়নি, সেভাবেই জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের বদলে মৃত্যুদণ্ড দিতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনেও রায় পাল্টায়নি।
আজহারের আবেদন নিয়ে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ বলছে, তারা শুনানির জন্য প্রস্তুত। আদালত তারিখ জানালেই বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আদালতের তালিকায় এলে অবশ্যই আমরা শুনানি করব।’
জামায়াত নেতার আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘আমরা রিভিউ পিটিশন করেছি। আদালত যখন মামলাটি কার্যতালিকায় দেবে, তখন আমরা শুনানি করব।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহার, কিন্তু উচ্চ আদালত থেকেও তিনি একই আদেশ শোনেন।
২০১২ সালের ২২ আগস্ট আজহারকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফাঁসি কার্যকর ছয়জনের
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এর আগে যে ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচ জন জামায়াত নেতা এবং একজন ছিলেন বিএনপি নেতা।
জামায়াতের যে পাঁচ নেতা ফাঁসিতে ঝুলেছেন, তাদের মধ্যে চার জনই এটিএম আজহারুল ইসলামের মতোই আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন।
এরা হলেন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী।
প্রথম ফাঁসিতে ঝোলা আবদুল কাদের মোল্লা আলবদর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন না। আর ফাঁসিতে ঝোলা অন্যজন হলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
এর মধ্যে কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে রায় দেয়। এ রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। আন্দোলনের মুখে আইন সংশোধন করে সাজা বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। ওই আপিলের শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল। একই বছরের ২২ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদেরকে।
পরের বছরের ১০ মে ফাঁসি দেয়া হয় মতিউর রহমান নিজামীকে। ২০১৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় মীর কাসেম আলীর।
জামায়াতের আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির রায় দিয়েছিল। পরে আপিল বিভাগ তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। এরপর থেকে জামায়াতের এই নেতা কারাবাস করছেন।