রাজধানীর পল্লবী থেকে ‘নিখোঁজ’ তিন কলেজছাত্রী কক্সবাজার হয়ে জাপান যেতে চেয়েছিল।
উন্নত, স্বাধীন জীবনযাপন ও উচ্চশিক্ষার জন্য হাফসা চৌধুরী নামে এক নারীর সহায়তায় তারা জাপানে যেতে ঘর ছেড়েছিল।
ঢাকায় ফেরার পর বুধবার ভোরে তিন কলেজছাত্রীকে মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে উদ্ধার করে র্যাব-৪।
বিকেলে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিন কলেজছাত্রীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানান র্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
তিনি জানান, কক্সবাজার যাওয়ার পর তিন কলেজছাত্রীর সঙ্গে থাকা টাকা ও স্বর্ণালংকার একজন নিয়ে যাওয়ার পর তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যে হোটেলে অবস্থান নিয়েছিল, তার আশপাশে র্যাবের উপস্থিতি দেখে তারা ঢাকায় ফিরে আসে।
কেন বাসা ছেড়েছিল ছাত্রীরা
র্যাব জানায়, ওই তিন কলেজছাত্রী মিরপুরের স্থানীয় কলেজে লেখাপড়া করত। করোনাভাইরাস মহামারিতে দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধ থাকায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। দিন দিন লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এর ফলে তাদের পরিবার পড়াশোনা ও ধর্মীয় বিধান মেনে চলার জন্য চাপ দিত। অতিরিক্ত পারিবারিক বিধিনিষেধের ফলে তারা বিরক্ত হয়ে পড়ে।
র্যাব-৪-এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘তাদের (তিন বান্ধবী) নিজেদের পরিবারের নিয়মকানুন ভালো লাগত না এবং এসব সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মকানুন তাদের কাছে অত্যাচার মনে হতো। তারা মূলত উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন পছন্দ করত। দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি, বিশেষ করে জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘তারা অধিক পরিমাণে জাপানি সিনেমা-সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম দেখে দেখে জাপানি ভাষা কিছুটা আয়ত্ত করে নেয়। তারা দেশ ছেড়ে স্বাধীন জীবনযাপন ও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করার কারণ হিসেবে জাপানি সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষের সম-অধিকার, স্বাধীনতা, দত্তক নেয়ার সুযোগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ না থাকার কারণ উল্লেখ করে।’
যেভাবে কক্সবাজার
র্যাব জানায়, ২ মাস আগে তিন বান্ধবী তাদের বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়ী এলাকায় ঘুরতে গিয়ে হাফসা চৌধুরী নামের ২৪-২৫ বছরের এক নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়। আলোচনার একপর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। হাফসা চৌধুরী তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
তিন বান্ধবী হাফসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যেতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বের হয়ে প্রথমে রিকশায় যায় গাবতলী।
হাফসার পরামর্শে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের অবস্থান চিহ্নিত না করতে পারে, সে জন্য তারা নিজেদের ই-মেইল, ফেসবুক আইডি এবং ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলী এলাকায় ধ্বংস করে। পরে তারা নৌকায় করে নদী পার হয়ে আমিনবাজার এলাকায় পৌঁছায়। সেখান থেকে হাফসার ২ জন লোক একটি কালো রঙের নোয়াহ গাড়িতে করে ঢাকারই এক জায়গায় নামিয়ে দেয় তাদের।
ঢাকার ওই জায়গা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যায় তিনজন। কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে চট্টগ্রামগামী কোনো ট্রেন না পাওয়ায় বাসে করে কুমিল্লার ময়নামতি যায় তারা।
পথে তারা নিজেদের পরিচয় গোপনের জন্য পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে নিজেদের চুল কেটে ফেলে; পশ্চিমা বেশভূষা ধারণ করে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস, পোশাক ও একটি মোবাইল কেনে। সেখান থেকে তারা আবার বাসে করে চট্টগ্রাম সিনেমা প্লেস বাসস্ট্যান্ডে যায়। সেখানে দুটি মোবাইল কিনে বাসে করে কক্সবাজার যায়।
কেন সিম কেনেনি
র্যাব জানায়, আত্মগোপনে থাকার জন্য কোনো সিম কেনেনি তিন ছাত্রী। কক্সবাজার পৌঁছে তারা ১ থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কলাতলীতে একটি হোটেলে অবস্থান নেয়। সিমের পরিবর্তে ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে তিনজন।
২ অক্টোবর তারা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকায় বেড়াতে গেলে হাফসার লোক পরিচয়ে আসিফ ও শফিক নামের ৩০ থেকে ৩২ বছরের দুজন তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও কিছু টাকা নিয়ে যায়। এ ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে হোটেল অবস্থান নেয়।
হোটেলের আশপাশে র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে ছদ্মবেশে বাসে করে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় তিনজন। আবদুল্লাহপুর পৌঁছালে বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।
হাফসা কোথায়
র্যাব জানায়, হাফসা নামের ওই নারীর কোনো ফেসবুক, ই-মেইল আইডি তিন কলেজছাত্রী শনাক্ত করতে পারেনি। এ কারণে হাফসাকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
হাফসা, নোয়াহ গাড়িতে থাকা ২ ব্যক্তি এবং কক্সবাজারের বিচে স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়া ২ জনসহ সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে র্যাব।