যশোরের মণিরামপুর উপজেলার কুচলিয়া গ্রামের সত্যজিৎ মন্ডল। ৩৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন অভয়নগরের ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
সত্যজিতের সহকর্মীরা বলছেন, তিন দশকের বেশি সময়ের এই পেশা জীবনে তিনি এক দিনও ছুটি নেননি। নিজের বিয়ে, এমনকি বাবার মৃত্যুদিনেও উপস্থিত ছিলেন স্কুলে। অসুস্থ অবস্থায়ও নিয়েছেন ক্লাস।
এমন গুণের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে পেয়েছেন ডজনখানেক পুরস্কার। চলতি বছরই যাবেন অবসরে।১৯৮৪ সালে বিএসসি পাসের মধ্যদিয়ে শিক্ষাজীবনের ইতি টানেন সত্যজিৎ। দুই বছর পর ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
এই প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৫ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হন। নিয়মিত নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞান পড়ান।
তার পাঠদান জয় করেছে অসংখ্য শিক্ষার্থীর মন। গুণী এই মানুষটি কর্মক্ষেত্রে যেমন সফল, তেমনি পরিবার প্রধান হিসেবেও। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি।
ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর করেছেন। মেয়ে পশুপালনের ওপর স্নাতকোত্তর করছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর স্ত্রী আরতী বিশ্বাস গৃহিণী।সত্যজিৎ মন্ডল বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শিক্ষকতা করার খুব ইচ্ছা ছিল। পড়াশুনা শেষ করে যখন চাকরি পাই, তখন নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করি, শিক্ষকতার জীবনে কোনো দিন ছুটি নেব না। বিজ্ঞান বিভাগে আর কোনো শিক্ষক না থাকায় আমার ক্লাসগুলো অন্য কোনো শিক্ষক নিতে পারতেন না। আমি মনে করতাম, যদি স্কুলে না যাই, তাহলে সেদিন স্কুলে আসা শিক্ষার্থীদের সেই অধ্যায় কেউ পড়াতে পারবেন না। এ কারণে শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে কখনও ছুটি নিইনি। সরকারি ছুটির দিনে শিক্ষার্থীদের না দেখলে আমার সেই দিন ভালো কাটত না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি এমন। প্রথম দিকে স্ত্রী একটুআধটু রাগ করতেন। এরপর আমার দেশসেরা শিক্ষক হওয়ার খবর জানতে পারি। ২০১৯ সালে ডেইলি স্টার পত্রিকা থেকে আমাকে পুরস্কার দেয়া হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনে এয়ারে ঢাকা যাই। তারপর থেকে তিনি নিজেও খুশি।’ সত্যজিৎ মন্ডল তার বিয়ের দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বিয়ে শেষ না করে সকালে উঠে স্কুলে গিয়েছিলাম। প্রথমে তো আমার পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন যেতে দিতে রাজি হয়নি। তারপর আমার প্রতিজ্ঞার কথা শুনে রাজি হয়। স্কুল শেষ করে আবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছর শেষ হবে চাকরির বয়স। অবসরে গেলে আমার গ্রামে পাঠাগার তৈরি করব। সেখানেই এলাকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে জ্ঞানচর্চা করার ইচ্ছা আছে।’ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তরুণ ঘোষ বলে, ‘আমরা অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টিতে স্কুলে যাই না। কিন্তু স্যার সেই মণিরামপুর উপজেলা থেকে স্কুলে চলে আসেন। স্যারের ব্যবহার খুব ভালো। তিনি বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে খুব সুন্দর করে বোঝান।’ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এখানে যোগ দেই। সেই থেকে সত্যজিৎ মন্ডল আমরা সহকর্মী। কোনোদিন দেখিনি ঝড়-বৃষ্টি বা অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিতে।’তিনি আরও বলেন, ‘সত্যজিৎ মন্ডলের সঙ্গে স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। স্কুল ৯টায় শুরু হলেও তিনি সাড়ে ৮টার মধ্যে উপস্থিত হন। চলতি বছর সত্যজিৎ মন্ডলের কর্মজীবন শেষ হবে। তাকে ছাড়তে হবে ভেবে খারাপ লাগছে। তারপরও তাকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে চাই।’