পদার্থ গঠনের পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা বদলে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ডের এক ল্যাবরেটরিতে স্রেফ আলো থেকে পদার্থ তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন তারা। বিষয়টি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের তাত্ত্বিক ধারণা এই প্রথম বাস্তবে প্রমাণ করা সম্ভব হলো।বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরীক্ষামূলক এই অগ্রগতি কোয়ান্টাম ও মহাজাগতিক পর্যায়ে ঘটে যাওয়া রহস্যময় প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করার দরজা খুলে দিয়েছে।রিলেটিভিস্টিক হেভি আয়ন কোলাইডার (আরএইচআইসি) ব্যবহার করে আলোর কণা ফোটনকে ইলেকট্রনে রূপান্তরিত করার কাজটিতে সফল হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকহেভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা।গবেষণাটির তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রায় একশ বছরের পুরোনো। শেষপর্যন্ত একে বাস্তবে প্রমাণ করতে ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ সোলেনাইডাল ট্র্যাকার অ্যাট আরএইচআইসি (স্টার)।স্টার গ্রুপের সদস্য এবং গবেষণাটি নিয়ে সম্প্রতি ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারে প্রকাশিত নিবন্ধের প্রধান লেখক শু শাঙ্কবু সংবাদ ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ভিত্তিক সাইট ভাইসকে বলেন, ‘পরীক্ষার সময় সবকিছু একবারে ঠিকঠাক মিলে গিয়েছিল। এই যুগান্তকারী পরীক্ষায় আমরা শক্তিকে পদার্থে পরিণত করতে পেরেছি।’আলো থেকে পদার্থ তৈরির উপযুক্ত অবস্থা তৈরি করার স্বপ্নের শুরু ১৯৩৪ সালে। ওই বছর দুই পদার্থবিদ গ্রেগরি ব্রিট ও জন হুইলার ধারণা দেন, দুটি ফোটনের সংঘর্ষে মাধ্যমে ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন ও ধনাত্মক চার্জের পজিট্রন তৈরি করে পদার্থের গঠন সম্ভব।ঋণাত্মক চার্জের ইলেক্ট্রন থেকে অ্যান্টিম্যাটার এবং ধনাত্মক চার্জের পজিট্রন থেকে তৈরি অ্যান্টিম্যাটার সম্মিলিতভাবে ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার জোড় তৈরি করবে।কোয়ান্টাম মেকানিকসের শুরুর দিকের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ ব্রিট-হুইলার পদ্ধতি নামে পরিচিত তাদের ওই ধারণা থেকে জানা যায়, কোয়ান্টাম পর্যায়ে ফোটন যে ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে সেটি প্রচলিত পদার্থবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।ওই দুই পদার্থবিদ আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সমন্বয় করা বিখ্যাত সূত্র E=mc2 এর ওপর ভিত্তি করে তাদের তত্ত্বটি দাঁড় করিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের সূত্রে প্রমাণিত হয়েছিল, ভর ও শক্তি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।তবে পদার্থকে শক্তিতে পরিণত করার চেয়ে শক্তিকে পদার্থতে পরিণত করা অনেকটাই কঠিন। ব্রিট ও হুইলার এজন্য এমন একটি যন্ত্রের কথা ভেবেছিলেন যার মাধ্যমে আয়ন বা ইলেকট্রনহীন অবস্থায় পরমাণুকে গতিশীল করা যাবে।ব্রুকহেভেনের গোল্ডহেবার ফেলো ব্র্যান্ডেনবার্গ বলেন, ‘৩০-এর দশকে যখন আধুনিক কোনো পরীক্ষার উপায় ছিল না, তখন এমন ধারণা তৈরি সত্যিই বিস্ময়কর। গ্রেগরি ব্রিট ও জন হুইলার তাদের গবেষণাপত্রের শেষ প্যারায় পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, কী করে এই কঠিন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা সম্ভব। আমরা এখন যে পরীক্ষা করে সাফল্য পেয়েছি ঠিক সেটির আলোচনা তারা সে সময় করেছিলেন।‘তারা শুধু তত্ত্বই দেননি, এই পরীক্ষা করার জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তির কথা প্রায় ১০০ বছর আগে বলে গেছেন।’যে পরীক্ষার কথা ব্রিট ও হুইলার বলে গেছেন সেটিই অনুসরণ করেছেন স্টার-এর বিজ্ঞানীরা। এই পরীক্ষায় আলোর গতির ৯৯.৯৯৫ শতাংশ গতিতে ভারী কোনো মৌলের দুটি আয়নের (এই ক্ষেত্রে স্বর্ণ) সংঘর্ষ ঘটানো হয়। আয়নের শক্তিশালী ধনাত্মক চার্জ এবং উচ্চ গতি একটি চৌম্বক ক্ষেত্র ও ফোটনের মেঘ সৃষ্টি করে, যা পার্টিকল কোলাইডারের মধ্যে কণাগুলোর সঙ্গে ঘুরতে থাকে।স্বর্ণের আয়নগুলো একে অপরের দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়ার সময় এদের চারদিকে ঘিরে থাকা ফোটন কণাগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটারের জোড় তৈরিবিজ্ঞানী দলের সদস্য লিজুয়ান রুয়ান বলেন, “মাত্র কয়েক বছর আগে ২০১৮ সালে, আমরা চমকপ্রদ কিছু জিনিস লক্ষ্য করা শুরু করি। তখনও বুঝতে পারিনি, এটাই সেই ব্রিট-হুইলার পদ্ধতি। আমরা ভারী আয়নের সংঘর্ষে যেমনটা সাধারণত প্রত্যক্ষ করি তার থেকে আলাদা কিছু দেখছিলাম। এরপর নিখুঁতভাবে ডিফারেনশিয়াল কাইনেম্যাটিকস ডেটাগুলো বিশ্লেষণ শুরু করে আমরা বলতে সক্ষম হয়েছি, ‘এটা আসলেই ব্রিট-হুইলার প্রক্রিয়া’।”
পরীক্ষাটি ভ্যাকুয়াম বায়ারফ্রিঞ্জেন্স নামে পরিচিত প্রায় শতবছরের পুরোনো একটি ধারণাকেও বাস্তব ভিত্তি দিয়েছে।১৯৩৬ সালে হানজ হাইনরিখ ও ভের্নার হাইজেনবার্গ (‘হাইজেনবার্গের আনসার্টিনটি প্রিন্সিপাল’ এর জন্য বিখ্যাত) হিসাব করে দেখেছিলেন, শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র শূন্যস্থানে চার্জ তৈরি করতে পারে। এই প্রক্রিয়া শূন্যস্থানে আলোর গতিপথে অদ্ভূত পরিবর্তন ঘটায়।২০ বছর পর পদার্থবিদ জন টোল ভ্যাকুয়াম বায়ারফ্রিঞ্জেন্সেস মাধ্যমে এই ধারণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ভ্যাকুয়াম বায়ারফ্রিঞ্জেন্স এমন একটা প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শূন্য মাধ্যমে চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে তৈরি চার্জের কারণে কীভাবে আলো শোষিত হয় তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব।বায়ারফ্রিঞ্জেন্স ক্রিস্টালের মতো বস্তুগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। ক্রিস্টালে আলো বিভক্ত হয়ে তরঙ্গে পরিণত হয় ও দ্বৈত বিম্ব সৃষ্টি করে। মহাকাশের বিশেষ পরিবেশে এটি দেখা যায়। মৃত কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের নিউট্রন তারার আশেপাশে এর দেখা মিলতে পারে। নিউট্রন তারার শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র আলোর মেরুকরণ প্রক্রিয়াকে প্রকাশিত করতে পারে।পৃথিবীতে এই বায়ারফ্রিঞ্জেন্স প্রক্রিয়া প্রথম করে দেখিয়েছে স্টার দলটি। কোয়ান্টান মেকানিকসের শক্ত একটি ভিত যাচাইয়ের অন্যতম পরীক্ষা ছিল এটি।ব্র্যান্ডেনবার্গ বলেন, ‘বিষয়টি দারুণ ইন্টারেস্টিং। কারণ ফোটনের কোনো চার্জ নেই, তাই চিরাচরিত ব্যাখ্যায় চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে এর প্রভাবিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যে কারণে এটি কোয়ান্টাম মেকানিকসের একেবারে মৌলিক কিছু বিষয় প্রমাণিত করে। একটি ফোটন ক্রমাগত ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড়াতে পরিণত হতে সক্ষম, যা চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। আমরা ঠিক সেটিই পরিমাপ করেছি।‘এখানে আসল আবিষ্কারটি হচ্ছে, এই পুরো বিষয়টি মহাকাশের শূন্যতায় একটা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতিতে করা সম্ভব। আর এটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো, এই প্রথম একটি ফোটনের ওয়েভফাংশন আমরা মাপতে পারছি।’এর আগে ১৯৯৭ সালে এক পরীক্ষায় এসএলএসি ন্যাশনাল এক্সেলেরেটর ল্যাবরেটরি লেসার ও ইলেক্ট্রন রশ্মির সংঘর্ষ ঘটিয়ে ফোটনের ইলেকট্রন-পজিট্রন জোড় তৈরি করতে সক্ষম হয়। তবে সেটি স্টার দলের মতো এতটা নির্ভুল ছিল না। স্টারের পরীক্ষায় ভ্যাকুয়াম বায়ারফ্রিঞ্জেন্সের কারণে এমন সব খুঁটিনাটি প্রত্যক্ষ করা গেছে, যেগুলো আগে কখনও দেখা যায়নি।ব্র্যান্ডেনবার্গ বলেন, ‘পরীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, এটিই প্রথম পরিমাপ যেখানে আমরা চোখের পলকের জন্য হলেও এই আল্ট্রাসনিক বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করতে পারি। এতে প্রথমবারের মতো আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তি-অতি শক্তিধর-চৌম্বকক্ষেত্রগুলোর উপস্থিতি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।’লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (এলএইচসি) সাম্প্রতিক এক পরীক্ষায় দুটি ফোটনের সংঘর্ষের মাধ্যমে শক্তিকে ভরে পরিণত করা হয়। এতে করে ডব্লিউ বোসন কণা উৎপন্ন হয়। প্রাকৃতিক চারটি মৌলিক শক্তির মধ্যে অন্যতম দুর্বল-নিউক্লিয়ার শক্তি তৈরি করা এই কণাগুলো বস্তুর এক ধরনের ক্ষণস্থায়ী অবস্থা। তবে ইলেকট্রনের তুলনায় ডব্লিউ বোসন একেবারে আলাদা কণা, যা এক সেকেন্ডের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে ক্ষয় হয়ে যায়।শু শাঙ্কবু বলেন, ‘এতে দুটো ফোটোন সংঘর্ষ করে একটা কিছু উৎপন্ন করে যার ভর রয়েছে কিন্তু এটা অবশ্যই ব্রিট ও হুইলার যা হিসেব করেছেন বা পূর্বাভাস করেছিলেন সেটা নয়। তাদের সময়ে দুর্বল শক্তি বা কোয়ান্টাম ক্রোমোডিনামিকসের কোনো ধারণা ছিল না। লেজার তখনও আবিষ্কার হয়নি।’