‘স্ত্রী-সন্তান কেউ এখন আর আমাকে বিশ্বাস করে না। সন্তানরা বলে, আমাদের জন্য কিছুই করতে পার নাই। আত্মীয়স্বজনও দুর্ব্যবহার করে সারাক্ষণ। মৃত্যুই এখন একমাত্র কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু চোখ বুজলে তো পাওনাদাররা মাফ করবে না।’
যুব কর্মসংস্থান সোসাইটিতে (যুবক) ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে এখন আক্ষেপ করছেন মো. মোজাম্মেল হোসেন। বলেন, ‘এক বুক স্বপ্ন নিয়ে নিজের এবং আত্মীয়দের অর্থ এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করি, কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, মূল টাকাই পেলাম না। টাকার শোকে কেটে গেছে এক যুগের বেশি সময়। আর কবে পাব টাকা, কবে একটু স্বস্তি নিয়ে মরতে পারব?’
উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নেয় যুবক। নিবন্ধন না নিয়েই ১৯৯৪ সাল থেকে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান।
২০১৬ সালে যুবকের ব্যবসাকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর শুরু হয় হইচই। এরই মধ্যে যুবকের কাছে ৩ লাখ ৩ হাজার গ্রাহকের পাওনা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা।
গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে গঠন করা হয় কমিটি। এরপর সাবেক যুগ্ম সচিব রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় যুবক কমিশন। এ ছাড়া আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দায়দেনা নিরূপণ এবং তা পরিশোধে প্রশাসক নিয়োগের পরামর্শ দেয় সবাই, কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
ফরাসউদ্দিন কমিটি
যুবকের গ্রাহকদের পাওনা অর্থ কীভাবে উদ্ধার করে দেয়া যায়, তা বের করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে সভাপতি করে ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ফরাসউদ্দিন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুবকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য গ্রাহকদের পাওনার চেয়ে বেশি। তবে কমিশন স্থির করে যে, যুবক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এ সম্পত্তি দখলে নিয়ে সেখানে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে তা বিক্রি করে গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যুবক যাতে এসব সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে না পারে, সে জন্য স্থগিতাদেশ আবশ্যক বলে মত দেয় কমিটি।
যুবক নিয়ে তৈরি করা প্রথম কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, যুবক ও যুবকের কর্মকর্তাদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং নামে-বেনামে হস্তান্তর করা সম্পত্তি প্রশাসনিক বা বিচারিক আদেশের মাধ্যমে সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা যায়। এ সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের আসল টাকা পরিশোধ করা যাবে। যুবক বা এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী কোনো গোষ্ঠী যাতে আর গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য অর্থ বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্থায়ী সংস্থা বা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এমএলএম কোম্পানির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।
রফিকুল ইসলাম কমিশন
দুই বছর মেয়াদে ২০১১ সালের ৭ মে সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে ‘যুবক কমিশন’ গঠন করে সরকার। এই কমিশন পাঁচটি সুপারিশ করে। যুবক গ্রাহকদের অর্থের পরিমাণ সুনির্দিষ্টকরণ, অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি নির্ধারণ, সকল সম্পত্তি বিক্রি এবং হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ছাড়াও প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ দেয় কমিশন। মেয়াদ পূর্তিতে কমিশন সুপারিশসহ প্রতিবেদনও দেয়। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই।
ঢাকায় যুবকের নামে রয়েছে এমন বেশ কয়েকটি ভবন। ছবি: নিউজবাংলা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি
যুবক গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেবার কৌশল বের করতে ২০১৪ সালের শেষ দিকে আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
১০ সদস্যের ওই কমিটির সুপারিশে বলা হয়, ‘কমিশন অব ইক্যুইটি অ্যাক্ট, ১৯৫৬ অনুযায়ী সরকার/বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুবক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধি নিয়ে প্রশাসনিক আদেশে জনস্বার্থ সম্পৃক্ত বিষয়ে কমিশন গঠন করে ধারা-১১ ক্ষমতাবলে ওই আইনের পুরো আইনি ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার একজন হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি/অবসরপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা/অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন অথবা পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করতে পারে।’
প্রশাসক নিয়োগ আর হয় না
অদৃশ্য কারণে এক যুগেরও বেশি সময় পরও যুবক নিয়ে কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়নি কেউ। বাধা কোথায় তাও স্পষ্ট না। তবে, আইনগত দিক সামনে আসায় এ বিষয়ে দায়িত্ব নেয়নি কেউ। মামলা থাকায় এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে দায় এড়িয়েছে মন্ত্রণালয় ও সংস্থা।
সম্পদ বিক্রি করছে যুবক
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কমিটি সম্পদের হিসাব চাইলে সেখানে তথ্য দেয় যুবক। তাদের তথ্যে দেখা যায়, ১৮টি বাড়ি, ১৮টি প্রকল্পসহ ২ হাজার ২০০ একর জমির মালিক যুবক।
এ ছাড়া অন্যান্য হিসাব বলছে, যুবকের মোট জমির পরিমাণ ৩ হাজার একর। প্রকল্প রয়েছে ১৮টি। আর বাড়ি রয়েছে ১৮টি, বর্তমান বাজারমূল্যে যা দাঁড়ায় ৬ হাজার কোটি টাকা। কার্যক্রম বন্ধের পর যে সম্পদ ছিল, এখন তা নেই। কোনোটি বিক্রি হয়েছে, কোনোটি আবার দখল হয়ে গেছে। নেপথ্যে থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় যুবকের একটি শিল্প প্লট ভোগদখল করছে যুবকের পুরোনো কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া পল্টনে বি কে টাওয়ার এখন দখল হয়ে গেছে। সেখানে দোকান দিয়ে ব্যবসা করছে প্রভাবশালী একটি মহল। ৫৩/১ নয়াপল্টনের একটি চারতলা বাড়ি দখলে নিয়েছে প্রভাবশালী মহল। সেখানে মাদ্রাসার নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, যুবকের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা জামিনে বের হয়ে নেপথ্যে থেকে সম্পদ বিক্রি এবং ভোগদখলে নেমেছেন।
যুবক ক্ষতিগ্রস্ত কমিটির সুপারিশ
যুবক গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষায় গঠন করা হয়েছে যুবক ক্ষতিগ্রস্থ জনকল্যাণ সোসাইটি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত এই সংগঠন এ সংকট সুরাহায় নানাভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কেউ সুরাহায় এগিয়ে আসেনি।
সবশেষ ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয়া হয়। সেখানে যুবক বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি কামনা করে প্রশাসক নিয়োগের দাবি তোলা হয়। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রশাসক নিয়োগের পরামর্শ দেন। বলেন, প্রশাসক নিয়োগের এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।
এর পরেও কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাণিজ্যসচিবকে চিঠি দেয়া হয়। উপসচিব মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘যুবকের সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে গ্রহণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও বিক্রয়পূর্বক এর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের জমাকৃত মূল আমানত পরিশোধের লক্ষ্যে একজন রিসিভার বা প্রশাসক নির্বাচন করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’
উদ্যোগ নিচ্ছেন বাণিজ্যমন্ত্রী
সম্প্রতি সাংবাদিকদের এক কর্মশালায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ডেসটিনি ও যুবকের প্রতারিত গ্রাহকেরা অন্তত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ টাকা ফেরত পেতে পারেন বলে মন্তব্য করেন ।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ডেসটিনি ও যুবকের সম্পদগুলোর দাম বর্তমানে বেড়েছে অনেক। ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করলেও যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে গ্রাহকদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ টাকা ফেরত দেয়া যাবে।
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘আইনমন্ত্রী আমাকে বললেন, এটা আদালতের বিষয়। কোনো সংস্থা দিয়ে সংযুক্ত করে ক্ষতিপূরণ দেয়া যেতে পারে। আইন মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কাজ করছে।’