বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিক্ষার মশাল হাতে আজীবন ছুটে চলা রসময় মোহান্ত

  •    
  • ৫ অক্টোবর, ২০২১ ২০:০৭

স্বাধীন দেশে ফিরে চাকরির কথা চিন্তা না করে রসময় মোহান্ত মনোযোগ দেন সমাজ সংস্কারে। এ জন্য শিক্ষাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন তিনি। এলাকার প্রবীণ-যুবক সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমলগঞ্জের শমসেরনগর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল শংকরপুর গ্রামে গড়ে তোলেন ‘শহীদ স্মৃতি জুনিয়র হাই স্কুল’।

‘প্রায় ৭০ হাজার মনিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে। তাদের মধ্যে এখন শিক্ষার হার ৯৫ শতাংশের ওপরে। শিক্ষার এই বিপ্লবের পেছনের কারিগর সর্বজন শ্রদ্ধেয় রসময় মোহান্ত স্যার। স্যার যদি কলেজ তৈরি না করতেন অনেকের স্বপ্ন অধরা থেকে যেত। তিনি শিক্ষার যে মশাল জালিয়েছেন তা সহস্র মশাল হয়ে জ্বলছে।’

কথাগুলো বলছিলেন রসময় মোহান্ত স্যারের ছাত্র বর্তমানে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক স্বপন কুমার সিংহ।

কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরি, খাসিয়া, গারোসহ ১৬টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বসবাস। এর বাইরে সেখানে ৮০টির বেশি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের স্বীকৃতি মেলেনি বলে জানিয়েছেন চা শ্রমিক অধিকার কর্মী মোহন রবিদাস দাস।

বরদাকান্ত ও সুভাষিণী দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় রসময় মোহান্ত। তার ছোট ভাই দীপঙ্কর মহন্ত নিউজবাংলাকে বলেন, বড় ভাইয়ের জন্ম উপজেলার ঘোষপুরে ১৯৪৭ সালে। ছোট বেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেধাতালিকায় অষ্টম স্থান লাভ করেন। তখন ১৯৬৪ সাল। এর দুই বছর পর সিলেটের মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় তৎকালীন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে মেধাতালিকায় ১৩তম স্থান অধিকার করেন।

১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে ভারতের শরণার্থী শিবিরে চলে যান। সেখানে শুরু করেন শিক্ষকতা।

স্বাধীন দেশে ফিরে চাকরির কথা চিন্তা না করে মনোযোগ দেন সমাজ সংস্কারে। এ জন্য শিক্ষাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন তিনি। এলাকার প্রবীণ-যুবক সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমলগঞ্জের শমসেরনগর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল শংকরপুর গ্রামে গড়ে তোলেন ‘শহীদ স্মৃতি জুনিয়র হাই স্কুল’। কিন্তু যুদ্ধের পর মানুষের পকেটে যখন টাকা নেই, ঘরে খাবার এই সময়ে স্কুল চালু রাখা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বড় ভাই দিন-রাত পরিশ্রম করে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টিভিক্ষা করে স্কুলটি চালু রাখেন।

কিন্তু এই এলাকার কলেজ না থাকায় এসএসসির পর ছাত্ররা ঝরে পড়ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় আশেপাশে কোনো কলেজে এই এলাকার ছাত্রদের পড়ার উপায় ছিল না।

ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্রনেতা স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোহাম্মদ ইলিয়াসের কাছে কলেজ তৈরির প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তিনি। ইলিয়াস সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। দিগুণ উৎসাহ নিয়ে কলেজ তৈরির জন্য নেমে পড়লেন। এলাকায় এলাকায় ঘুরে যুবক, প্রবীণ সবার সঙ্গে মিটিং করে গণমানুষকে যুক্ত করলেন কলেজ তৈরির কাজে। পাশে পেয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা কিছু ছাত্র, যাদের মধ্যে বর্তমান এমপি উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এবং বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামও ছিলেন।

গণমানুষের চাঁদায় গড়ে তোলেন ‘কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়’ গণমানুষের সাহায্যে গড়া হয়েছে বলে নাম গণমহাবিদ্যালয়।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে এলাকাবাসী দ্বায়িত্ব দেন বড় ভাইকে (রসময় মোহন্ত)। প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেয়া হতো না। বিনা বেতনে শিক্ষকতা করতেন তিনি। দিনে শিক্ষকতা আর রাতে মেধাবী ছাত্রদের উৎসাহ দিতে বাড়ি বাড়ি ছুটে যেতেন।

তার এমন উদ্যোগে পিছিয়ে পড়া চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও শিক্ষার বিস্তার শুরু হয়। আলীনগর চা বাগান থেকে সুধাকর কৈরী প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। সেই ছাত্র বর্তমানে মৌলভীবাজারের নাম করা গাইনি বিশেষজ্ঞ।

ড. সুধাকর কৈরী নিউজবাংলাকে বলেন, স্যারের কথা এত ছোট করে প্রকাশ করা যাবে না। তার অবদান এই এলাকার মানুষ আজীবন মনে রাখবে।

তিনি বলেন, আমি যতদূর জেনেছি, স্থানীয় ‘অস্পৃশ্য’ শব্দকর (ডুগলা/বাদ্যকর) সমাজের কেউ স্কুলে পড়ত না। তাদের ঘরে তুলতে চাইত না। ফলে এই শ্রেণির মানুষের সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য ১৯৯৫ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘আত্ন উন্নয়ন সমিতি’। এই কাজে তাকে সাহায্য করেন সুলতানা নাহার, আব্দুর রাজ্জাক, আহমদ সিরাজসহ আরও অনেকে। এই সমিতির মাধ্যমে শব্দকর সমাজের মানুষ নিজেদের সচেতন করতে প্রয়াস পায়।

আজীবন শিক্ষার আলো বিলানো এই গুণী শিক্ষক ২০০৮ সালে অবসরে যান। তবে এখনও শিক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন বিভিন্ন ভাবে। তার নিজ বাড়ি হয়ে উঠেছে অঘোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

নিজের জীবন নিয়ে তৃপ্তি বা হতাশা কিছুই নেই জানিয়ে রসময় মোহন্ত জানান, ‘যা করেছি নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই করেছি। আমি বিশ্বাস করি, কাজ আমার তবে ফল আমার নয়। ফল কী এসেছে তা মানুষ মূল্যায়ন করবে। আমি ছাত্রজীবনে ডাল-ভাত খেতাম এখনও তাই আছি। শহরে বাড়ি নেই, গাড়ি নেই তা নিয়ে হতাশা নেই। গ্রামের মানুষ গ্রামেই আছি মানুষের ভালবাসা পেয়েছি।

এক ছেলে এক সন্তানের জনক রসময় মোহন্ত বলেন, ‘মেয়ে স্বামীর সাথে সুখেই আছে। ছেলে এমবিএ শেষ করেছে কিন্তু ভাল চাকরি টাকরি হয়নি। বাবা হিসেবে আমি তেমন খেয়াল করতে পারিনি। আর খেয়াল করতে গেলেও চাকরির জন্য যা যা করতে হয় শুনেছি তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

নিজের আত্মজীবনীমূলক বই লিখছেন রসময় মোহান্ত। তবে ইতিমধ্যে তার লেখা ২০টি বই বের হয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে।

এ বিভাগের আরো খবর