ট্রেনের ছাদে যাত্রী ওঠা থামানো যাচ্ছে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাদে উঠে ভ্রমণ করে যাত্রীরা। এ কারণে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
২৩ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী একটি কমিউটার ট্রেনে ডাকাতির ঘটনায় দুইজন নিহত ও একজন আহত হন। আর এই ডাকাতি হয়েছিল ট্রেনের ছাদে। ইতিমধ্যে ঘটনায় জড়িত অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ছাদে ওঠা বন্ধ না হওয়ার পেছনে তদারকির অভাবকে দায়ী করছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা বলছেন, একটা ট্রেনে যে সংখ্যক পুলিশ সদস্য থাকা প্রয়োজন, তা থাকেন না। অনেক ট্রেনে কোনো পুলিশ সদস্যই থাকেন না।
কমলাপুর থেকে দেওয়ানগঞ্জের যাত্রী মো. রবিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ডাকাতের হামলায় যারা মারা গেলেন, তাদের একজন আমাদের এলাকার। ট্রেনে পুলিশ হঠাৎ-সঠাৎ চোখে পড়ে। একজন বা দুইজন থাকে। অনেক সময় থাকেও না। ডাকাত তো আর এক-দুইজন আসে না। ১০-১৫ জন করে আসে। এই এক-দুইজন পুলিশ দিয়ে ডাকাত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না।’
ছাদে লোক ওঠার বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘ছাদে লোক উঠলে নামতে বলে। তবে পুলিশ না দেখলেই আবার তারা ছাদে ওঠে। রাতের জন্য তেমন এক্সট্রা সিকিউরিটি দেয়া হয় না।’
কমলাপুর থেকে কেউ ট্রেনের ছাদে উঠতে পারে না বলে দাবি করেছেন কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ট্রেন গাজীপুর, টঙ্গি ছেড়ে গেলে ছাদে ওঠা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় থাকে না। কঠোর নির্দেশনা রয়েছে, ছাদে লোক ওঠানো যাবে না। এটা গাজীপুর পর্যন্ত ঠিক থাকে। এরপর আর ঠিক থাকে না। ঢাকার বাইরে নিরাপত্তার কথা বেশি ভাবা জরুরি।’
কেন ছাদে ওঠে যাত্রীরা?
কমলাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল হক বলেন, ‘কিছু লোক আছে এমন যে, ট্রেনে জায়গা থাকলেও দৌড়ে ছাদে ওঠে। তারা ট্রেনে ফ্রি যাওয়ার জন্যই মূলত ছাদে ওঠে। আবার অনেকে টিকিট কেটেও ছাদে ওঠে। এটা কেন ওঠে, জানি না।’
ওসি মাজহারুল বলেন, ‘পুলিশ স্টেশন শতভাগ ব্যারিকেড দেয়া না। কমলাপুরের স্টেশন সম্পূর্ণভাবে ব্যারিকেড দেয়া। অন্য স্টেশন এমন না। ট্রেন স্টেশন ত্যাগ বা ঢোকার সময় ধীর গতিতে থাকে। তখন এই মানুষগুলো ছাদে ওঠে বা নামে। ছাদ থেকে নেমে স্টেশনের যে পাশে ব্যারিকেড নাই, ওই এলাকা দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে বিনা পয়সায় ট্রেনে চলতে পারে। কিছু কিছু এলাকার মানুষের ধরনই হচ্ছে ছাদে ওঠা। তবে এই অল্প টাকার জন্য যে তার জীবনের ঝুকি রয়েছে, সেটা তারা বুঝতে চায় না।’
ছাদে লোক না ওঠার জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে – এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, ‘আমাদের জনসচেনতা বাড়াতে হবে। টাকা বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নেয়া যাবে না, এটা বোঝাতে হবে।’
রেল পুলিশে লোকবল কম
বর্তমানে প্রতিদিন ৭৪টি ট্রেন কমলাপুরে আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে রাতে যাতায়াত ২০ থেকে ২৫টি ট্রেনের।
কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বলেন, ‘জিআরপি পুলিশের স্বল্পতা রয়েছে। আন্তনগর ট্রেনে আগে একজন অফিসারের নেতৃত্বে তিনজন কনস্টেবল থাকতেন। এখন মনে হয় ওনাদের অফিসার স্বল্পতার কারণে লোক একটু কমেছে।
‘শুধু যাত্রী না, আমাদের রেলের কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা নিয়েও আমরা সন্তুষ্ট নই। গত এক বছরে আমাদের আট থেকে ১০ জন সদস্য আহত হয়েছেন। ঢাকায় কোনো ঝামেলা হলে আমি ফোন করে দাঙ্গা পুলিশ পাঠাতে পারি। তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু ঢাকার বাইরে এটা কি সম্ভব?’
পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ট্রেনের ছাদে
রেলের কমলাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, যাত্রীরা ছাদে ওঠে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার সময় ধীরে ধীরে গতি বাড়ে। ট্রেন স্টেশনের বাইরে যখন যায়, তখন তারা ছাদে ওঠে। স্টেশনের বাইরে তো পুলিশ থাকে না। রাতে যদি ট্রেনের ছাদে যাত্রী যায়, তাদের নিরাপত্তা নাই। যাত্রীর পাশাপাশি ছাদে ছিনতাইকারীও উঠতে পারে। ছাদে তো আর পুলিশ দেয়া সম্ভব না।
তিনি বলেন, ‘সব ট্রেনে পর্যাপ্ত টিটি থাকলে এই ছাদে ওঠার প্রবণতা কমত। বিশেষ করে বেসরকারি ট্রেনগুলো পর্যাপ্ত টিটি দিতে পারে না। এ কারণে লোকাল ট্রেনে টিকিট ছাড়া ভ্রমণের লোক বেশি।’
অভিযোগ পাওয়া গেছে, ট্রেন ঢাকা ছাড়ার পর ছাদে ওঠা যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না পুলিশ। এর উত্তরে ওসি বলেন, ‘না, এ অভিযোগ সঠিক না। যাত্রীরা আন্তনগর ট্রেনের ছাদে উঠতে পারে না। ঈদের সময় ওঠার চেষ্টা করে, তখনও আমরা বাধা দিই। লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রে স্টেশনের বাইরে যখন ট্রেনে যায়, তখন উঠতে পারে।’
কমলাপুর থানা রেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা। এই থানায় ওসিসহ মোট ৬২ জন পুলিশ সদস্য। এই অল্পসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়ে হিমশিম খেতে হয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে।
এ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বড় বড় ট্রেনে দুজন কনস্টেবল দিতে পারি। সর্বোচ্চ তিনজন লোক দিতে পারি, তাও দূরের ট্রেনগুলোতে। কাছাকাছি এলাকার ট্রেনে লোক ঠিকমতো দিতে পারি না। আমার অফিসার নাই, ফোর্স নাই। নিয়ম অনুযায়ী পাঁচজনের একটা দল পাঠাতে হয়। এই টিম পুরা না হলে অস্ত্র ঠিকমতো দিতে পারি না।’
কমলাপুর থানায় কনস্টেবল আছেন ৪৫ জন, যার তিনজন নারী। এসআই আটজন, এএসআই তিনজন, সার্জেন্ট একজন, টিএসআই একজন, এটিএসআই দুজন এবং ওসি ও সেকেন্ড অফিসার।
মাজহারুল হক বলেন, ‘ডিউটি অফিসারের ডিউটি, নারী ও শিশু হেল্প ডেস্কের ডিউটি, প্ল্যাটফর্ম এক ও দুইয়ে অফিসারসহ কনস্টেবল থাকে, তথ্যকেন্দ্রে দিতে হয়, নারায়ণগঞ্জ প্ল্যাটফর্মে, প্ল্যাটফর্মের বিভিন্ন জায়গায়। এ ছাড়া আমার থানার আওতার প্ল্যাটফর্মে, থানায় ডিউটিতে পুলিশ মোতায়েনসহ ট্রেনে পুলিশ দিতে হয়। এই সামান্য পুলিশ দিয়ে এত কিছু ম্যানেজ সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
ছয় ট্রেনে পুলিশ
কমলাপুর থানা থেকে বলা হচ্ছে, তারা ছয় ট্রেনে পুলিশ সদস্য দেন। তবে থানা সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার তিন ট্রেনে পুলিশ সদস্য দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মোহনগঞ্জ আন্তনগর ট্রেনে দুজন কনস্টেবল, সোনার বাংলায় একজন এটিএসআই ও একজন কনস্টেবল, ব্রহ্মপুত্রে দুজন কনস্টেবল।
মাজহারুল হক বলেন, ‘আমি তো সব ট্রেনে পুলিশ দিতে পারি না। আমরা ছয়টা ট্রেনে পুলিশ দিই। অন্যান্য থানা থেকেও পুলিশ দেয়া হয়। তবে এই পুলিশ দিয়ে সকল ট্রেন কাভার করা সম্ভব হয় না। আমরা পারাবত, মোহনগঞ্জ, ব্রহ্মপুত্র, সোনারগাঁও, মহানগর প্রভাতি ও চিটাগাং মেইল ট্রেনে পুলিশ দিই। এই ছয় ট্রেনে আমরা ট্রেন গার্ড (টিজি) দিই। এ ছাড়া অন্যান্য জেলা থেকেও দেয়া হয়।
ছয় ট্রেনে পুলিশ দিয়ে ট্রেনের সার্বিক নিরাপত্তা সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘চলছে এভাবেই।’