বিজ্ঞাপনমুক্ত (ক্লিন ফিড) সম্প্রচারের শর্তের কারণে তিন দিন ধরে কোনো বিদেশি চ্যানেল দেখতে পারছেন না দেশের টিভি দর্শকরা। এ সংক্রান্ত ১৫ বছর আগের আইন প্রয়োগে এবার অনড় সরকার।
কেব্ল টিভি অপারেটরা চান, এ সিদ্ধান্ত আরও কিছু সময়ের জন্য শিথিল করুক সরকার। এ নিয়ে আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছে তাদের একাংশ।
দর্শকরা বলছেন, তারা টাকা দেন, সব ধরনের চ্যানেল দেখার জন্য। তাই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এ সমস্যার সামাধান হোক।
বাংলাদেশে বিদেশি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারসংক্রান্ত আইন করা হয় ২০০৬ সালে, যার নাম ‘কেব্ল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন’। এ আইনে বলা আছে, যেসব বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, সেসব চ্যানেল বাংলাদেশে প্রদর্শন করা যাবে না। প্রচার করতে গেলে বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রচার করতে হবে। এতে বিবিসি-সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক খবরের চ্যানেল, খেলার চ্যানেল এবং ভারতীয় বিনোদন চ্যানেলগুলোসহ সব বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দেয় কেব্ল অপারেটররা।
কেব্ল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে ১০০টিরও বেশি চ্যানেল রয়েছে।
কী বলছেন কেব্ল অপারেটররা
দেশের গ্রাহকদের কাছে টিভি সংযোগ পৌঁছে দিচ্ছেন কেব্ল অপারেটররা। তারা বলছেন, বিজ্ঞাপন ছাড়া অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে তাদের কোনো দায় নেই, তাদের সে সুযোগও নেই। কিন্তু ভুগতে হচ্ছে তাদেরকে। গ্রাহকদের কাছ থেকে তারা নানা কথা শুনছেন। অনেক গ্রাহক মাসিক টাকা না দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন। তাই আরও কিছু সময় চান অপারেটররা।
কেব্ল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (কোয়াব) সভাপতি আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘আমরা সরকারের আইন ও বিধিনিষেধ মেনেই ব্যবসা করব। কিন্তু আমাদের আরও কিছু সময় প্রয়োজন। এ খাত ডিজিটাইজড করার পর এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলে আমাদের ব্যবসা টিকে থাকবে। ডিজিটাল হলে আমাদের মার্কেটের পরিধিও বাড়বে।
‘যেমন আমি কোনো বাসায় একটি কানেকশন দিয়েছি, কিন্তু সেখানে হয়তো ১৫টা টিভি চলে। কিন্তু তা আমরা বুঝতে পারছি না। এখন এটা ডিজিটাইজড হলে, সেট-টপ বক্স বসলে বুঝতে পারব কত সংযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি পুরো সহযোগিতা ও আর্থিক সুবিধা দেয়, তাহলে আগামী এক বছরে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’
এদিকে শনিবার কেব্ল অপারেটরস সমন্বয় কমিটি নামে কোয়াবের একটা অংশ চার দফা দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে।
৪ অক্টোবরের মধ্যে কেব্ল টিভি নিয়ে জটিলতার অবসান না হলে দেশের কেব্ল অপারেটরদের নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে তারা।
এ অংশের নেতা সৈয়দ মোশারফ আলী বলেন, ‘ক্লিন ফিড করার দায়িত্ব আমাদের না। এ জন্য ব্রডকাস্টার ও ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে। কিন্তু ভোগান্তিতে পড়েছি আমরা। তাই আমরা এর সমাধান চাই।’
তথ্যমন্ত্রী যা বললেন
রোববার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহ্মুদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সব দেশে আইন মেনে চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করে থাকে। শুধু আমাদের দেশে আইনকে বছরের পর বছর ধরে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হচ্ছিল। আমরা আইন বাস্তবায়নের কথা দুই বছর আগে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলেছিলাম। বেশ কয়েকবার তাগাদা দেয়া হয়েছে, নোটিশ করা হয়েছে। গত মাসের শুরুতে তাদের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো বসে সিদ্ধান্ত হয়, ১ অক্টোবর থেকে আইন কার্যকর করা হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা, ফ্রান্স টিভি, রাশান টিভি, ইউরো টিভি, অ্যানিমেল প্ল্যানেটসহ ১৭টি টিভি বাংলাদেশে ক্লিন ফিডে আসে। এই চ্যানেলগুলো সম্প্রচারে কোনো আইনগত বাধা নেই। কিন্তু কেব্ল অপারেটররা লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে এগুলোরও সম্প্রচার বন্ধ করেছেন।
‘কেউ কেউ বলছে ডিজিটাইজড না হওয়া পর্যন্ত আইন শিথিল রাখতে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় পুরোটা ডিজিটাইজড হয়নি। সেখানে আইন কার্যকর আছে। আগেও ২ বছর সময় দেয়া হয়েছে। আমি ২ বছর আগ থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি। এর আগেও এই আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম।’
অপারেটরদের আন্দোলন সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘যেসব চ্যানেল দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে, সংস্কৃতিকে চোখ রাঙাচ্ছে, সেগুলোর পক্ষে ওকালতি করা দেশের স্বার্থ ও আইনবিরোধী। আমি আশা করব, দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হবেন না। সরকার কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। সরকার দেশের স্বার্থ ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য, আইন বাস্তবায়ন করার জন্য বদ্ধপরিকর।’
সিএনএন-ডিসকভারিও বন্ধ কেন
শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ সম্পর্কে কোয়াব প্রেসিডেন্ট আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘সিএনএন, ডিসকভারির মতো সব চ্যানেলই বিজ্ঞাপন প্রচার করে। ট্রাভেলসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার হয় এসব চ্যানেলে। বিজ্ঞাপন প্রচারের সময় যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত আসে, তাহলে তো আমরাই বিপদে পড়ব। এখন এ বিষয়ে কোনো আলাদা নির্দেশনা আমাদের দেয়া হয়নি।’
এ বিষয়ে মোশাররফ আলী বলেন, ‘আমরা এমন কোনো চ্যানেল পাই না, যেখানে বিজ্ঞাপন নেই। সরকার তো বলেছে, বিজ্ঞাপন থাকলে চালানো যাবে না। কম আর বেশির কথা তো বলা হয়নি। যদি বলত সীমিত বিজ্ঞাপনের চ্যানেল চলবে, তাহলেও তো হতো। কিন্তু আমাদের কিছুই বলা হয়নি। আমাদের কাছে তো কোনো প্রপার গাইডলাইনও নেই।
‘ব্রডকাস্টার ও লোকাল ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে কথা বলে সমন্বয় করে সরকার এটার সমাধান করুক, এটা চাচ্ছি। সরকারের এ নির্দেশনার সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। বরং এটা হলে তো আমাদের জন্য ভালো। দর্শকরাও বিজ্ঞাপন ছাড়া অনুষ্ঠান পাবে।’
মোশররফ বলেন, ‘সরকার নিশ্চিত করুক কাল থেকে বিজ্ঞাপন ছাড়া সব চ্যানেল পাওয়া যাচ্ছে, অথবা লোকাল ডিস্ট্রিবিউটরদের বলে দিক এত দিনের মধ্যে ক্লিন ফিড করতে হবে। কিন্তু যতদিন না বিজ্ঞাপন ছাড়া চ্যানেল পাওয়া না যায়, ততদিন চ্যানেলগুলো চলতে দেয়ার দাবি করছি আমরা। দর্শকরা যেন বঞ্চিত না হয়। এখন মাসের শুরু, আমরা টাকাও তুলতে পারছি না।’
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘চ্যানেলগুলো তো অনুমোদন ছাড়া এ দেশে চলে না। তাহলে অনুমোদনের সময় কেন বিজ্ঞাপনসহ এগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছিল?’
ক্লিন ফিড করবে কে?
টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচারে তিনটি পক্ষ জড়িত: ব্রডকাস্ট কোম্পানি, ডিস্ট্রিবিউটর ও স্থানীয় কেব্ল অপারেটর। সরকার এখানে থাকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। তবে স্থানীয় কেব্ল অপারেটররা যেহেতু সংখ্যায় অনেক এবং তাদের গ্রাহকসংখ্যাও সীমিত, তাই তারা ক্লিন ফিড চাইলেও করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে দায় ব্রডকাস্ট কোম্পানি ও স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটরের।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যেসব চ্যানেল ক্লিন ফিড পাঠায় না, এ দেশে তাদের এজেন্ট আছে। এই দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট চ্যানেল ও এজেন্টের। এটি কেব্ল অপারেটরদের দায়িত্ব নয়। কিন্তু কোনো কোনো কেব্ল অপারেটর এজেন্টদের পাশ কাটিয়ে সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে পাইরেসি করে ডাউনলোড করে। সেটি কিন্তু তারা করতে পারেন না। এটি আইনবহির্ভূত।’
সমাধান কোথায়
অ্যাটকো বলছে, কেব্ল অপারেটররা এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ঘরে ঘরে চ্যানেলগুলো পৌঁছে দিচ্ছে তারাই। কিন্তু এ অবস্থায় তাদেরই বেশি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ক্লিন ফিড ব্যবস্থা করা ডিস্ট্রিবিউটরদের কাজ। তাই তাদের বাধ্য করতে হবে।
অ্যাটকোর সহসভাপতি মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘ডিস্ট্রিবিউটরদের এটা বাধ্য করতে হবে যে তারা ক্লিন ফিড ব্যবস্থা করবে। আমরা কেব্ল অপারেটরদের সঙ্গে একমত। তাদের ক্ষতি আমরাও চাই না। কেব্ল অপারেটররা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, ডিস্ট্রিবিউটররাও হচ্ছে।’
কোয়াব সভাপতি আনোয়ার পারভেজও বলেন, ‘এখন অ্যানালগ সংযোগের কারণে ব্রডকাস্টার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের আয় অনেক কম। ডিজিটাল হলেই প্রকৃত কেব্ল সংযোগসংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। তখন চ্যানেলগুলোর আয়ও বেড়ে যাবে। তারা যখন দেখবে দেশের কোটি গ্রাহক থেকে তারা বড় অঙ্কের আয় করছে, তখন তারা বিনিয়োগ করে এ দেশে ক্লিন ফিড পাঠাতে বাধ্য হবে।’
মোশাররফ আলীও বলেন, ‘দেশে চারটি ডিস্ট্রিবিউটর প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মাধ্যমেই চ্যানেলগুলো প্রচারিত হয়। তাই তাদের বাধ্য করা গেলে সমস্যার সমাধান হবে। আমরা আন্দোলন চাই না, সমস্যার সমাধান চাই। মানুষ টাকা না দিলে আমাদের ব্যবসা টিকবে কীভাবে। অথচ আমাদের কোনো দায় নেই।’
প্রশ্ন রাজস্ব হারানোর
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেল প্রচারে সরকার কয়েক শ কোটি টাকার রাজস্ব হারায়। এই বিনিয়োগ বঞ্চিত হওয়ার কারণে মিডিয়া থেকে অনেকে ছাঁটাই হচ্ছেন। যখন এই বিনিয়োগটা দেশি মিডিয়ার হবে, তখন মিডিয়া থেকে ছাঁটাই হওয়াটা বন্ধ হয়ে যাবে বা সেই অজুহাতে ছাঁটাই করা যাবে না। এভাবে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।’
অ্যাটকো বলছে, বিজ্ঞাপন পাচার বা অ্যাড ওভারফ্লোর মাধ্যমে দেশের টেলিভিশন শিল্প ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হারাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। সরকারও অন্তত ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এটা কিছুতেই যেন ব্ল্যাক আউটের পর্যায়ে না যায়। গ্লোবাল ভিলেজে কোনো চ্যানেলের ওপর বাধা থাকুক সেটা অ্যাটকো চায় না। অ্যাটকো সরকারের এ অবস্থানকে সমর্থন করছে। এর সমাধানও চায়।