বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্বরূপ উন্মোচিত হলে দলটির নেতারা লজ্জিত হবেন বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ।
রোববার বিকেলে রাজধানীর জুরাইন রেলগেট চত্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বিএনপি নেতা ফখরুল সাহেব, রিজভী সাহেব বড় বড় কথা বলেন, গয়েশ্বর বাবু তালে-বেতালে কথা বলেন। বিএনপি খুনীর দল। জিয়া একজন খুনী এবং তার স্বরূপ যখন আরও উন্মোচিত হবে, আজ তার দল করার জন্য একদিন তারা লজ্জিত হবেন।
‘বিএনপির জন্মটাই হয়েছে মানুষকে খুন করার মধ্য দিয়ে। তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে হাজার হাজার অফিসার ও জওয়ানকে হত্যা করেছেন। বিমান ও সেনা বাহিনীর যে সদস্যদের জিয়া হত্যা করেছিলেন, তারা গতকাল (শনিবার) সভা করে জিয়ার মরণোত্তর বিচার দাবি করেছেন।’
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। ফাইল ছবি
আওয়ামী লীগকে মেহনতি মানুষের দল হিসেবে বর্ণনা করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এরশাদ সাহেবের স্যুট-কোট-টাই পরা মানুষের ড্রইংরুমের দল নয়, জিয়ার সাফারি-কোট পরা মানুষের দলও নয়। আওয়ামী লীগ গরীব মেহনতি মানুষের কথা বলে। আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের দল আর জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই সাধারণ মানুষদের নেতা।
‘সে কারণেই গত ১৩ বছরে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে’, যোগ করেন তিনি।
জিয়ার নির্মমতার বিচার দাবি
অভ্যুত্থানচেষ্টার অভিযোগ এনে ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সামরিক বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের হত্যার দায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার দাবি জানান ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই দাবি জানানো হয়।
ফাঁসির নামে হত্যার শিকার সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা ১২০টি পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। একে একে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে স্বজন হারানোর কষ্টের স্মৃতি বর্ণনা করেন।
বক্তব্য দেয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। উপস্থিত শ্রোতারাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত সার্জেন্ট দেলোয়ার হোসেনের ছেলে নূরে আলম বলেন, ‘আমি জানতে চাই। আমার বাবা যদি অপরাধী হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রমাণ দেন। আমার বাবার কবর কোথায় হয়েছে সেটা জানান। দেশবাসী জানুক আমার বাবাকে কেন অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সেই সময় কী ঘটেছিল, সেটা জানার অধিকার আমার ও দেশবাসীর রয়েছে। আমার বাবাসহ প্রায় তিন হাজারের বেশি অফিসারকে বিভিন্নভাবে হত্যা করে হয়েছে। কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে অন্যায়ভাবে সেনা ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা হত্যা করতে জিয়াউর রহমানের নীলনকশা ছিল। এ জন্য জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার করতে হবে।’
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক সার্জেন্টের স্ত্রী লাইলা বেগম বলেন, ‘আমি শুনেছি আমার স্বামীকে ফাঁসি দেয়া হয়। কিন্তু আমার স্বামীর লাশ এখনও পাইনি। ৪৪ বছর আমি স্বামীহীন সংসার করছি। দেড় বছরের একটি ছেলে সন্তান রেখে স্বামী চলে যান। সংশ্লিষ্ট বাহিনী থেকে একবার চিঠি দিয়ে জানানো হয় আমার স্বামীকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।
ফাঁসির শিকার সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা ১২০টি পরিবারের সদস্যরা শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। একে একে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে স্বজন হারানোর কষ্টের স্মৃতি বর্ণনা করেন। ফাইল ছবি
‘আমার জীবনে একটাই ইচ্ছা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাক্ষাৎ করে আমার স্বামী হত্যার জন্য সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার চাইব। স্বামী ছাড়া ৪৪ বছর কাটানো কত কষ্টের এটি প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় বুঝবেন স্বজন হারানোর কষ্ট কী। কারণ, তিনিও স্বজন হারিয়েছেন।’
কী ঘটেছিল সে সময়
আয়োজনে জানানো হয়, ১৯৭৭ সালে জাপানের উগ্রপন্থি গোষ্ঠী ‘রেড আর্মির’ সদস্যরা জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকা বিমানবন্দরে (বর্তমান পুরাতন বিমানবন্দর) অবতরণ করিয়েছিল। ওই ঘটনার অবসানের ব্যবস্থা নিতে তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধানসহ বিমান বাহিনীর বিরাট একটা অংশ সার্বক্ষণিকভাবে কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১ অক্টোবর যখন বিমান ছিনতাই ঘটনার অবসান ঘটে, সেই রাতে জিয়াউর রহমানের অনুগত বাহিনী ঢাকা সেনা ও বিমান বাহিনীর ছাউনিতে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। তারা শত শত ঘুমন্ত সৈনিককে ব্যারাক থেকে অস্ত্রের মুখে বের করে নিয়ে আসে এবং পরে তাদেরকেই অভুত্থানের অভিযাগে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে হত্যা করে।
লিফলেটে বলা হয়, ষড়যন্ত্রকারীরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিভিন্ন নির্যাতন কক্ষে নিমর্মভাবে পিটিয়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে শত শত সৈনিককে হত্যা করে। বিভিন্ন ট্রাইবুনালে বিচারের নামে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অন্যায়ভাবে ফঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়। কত সৈনিককে এই শাস্তি পেতে হয়েছিল, তার খবর দেশবাসী আজও সঠিকভাবে জানে না।
এতে বলা হয়, ফায়ারিং স্কোয়াড ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে প্রায় এক হাজার চারশ সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করা হয়। ওইদিন তেজগাঁও বিমানবন্দরে ও সেনানিবাসের বিভিন্ন স্থানে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং ফায়ারিং স্কোয়াড যাদেরকে মারা হয়েছে তাদের হিসাব জানা নাই।
জিজ্ঞাসাবাদের নামে সৈনিকদেরকে হাত, পা ও চোখ বেঁধে দিনের পর দিন ফেলে রাখার অভিযোগও করা হয় লিফলেটে। বলা হয়, চোখ বাঁধা অবস্থাতেই সৈনিকদের অনেকের সই নেয়া হয় কোনো অজানা কারণে।
প্রচলিত নিয়ম অনুসারে কোনো অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি দেয়া হয় না। কিন্তু সে সময় নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষতবিক্ষত অর্ধমৃত সৈনিকদেরকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
আগে ফাঁসি পরে বিচারের রায়
আয়োজকরা জানান, ফাঁসি দেয়া শুরু হয় ১৯৭৭ সালের ৮ অক্টোবর থেকে। কিন্তু আদেশ জারি হয় তার ৬ দিন পর ১৪ অক্টোবর থেকে।
জিয়াউর রহমানের গঠন করা ‘মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল’ একেকজন সৈনিকের জীবণের সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে ১ মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিল।
যারা ট্রাইব্যুনালের বিচারক হয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী অনেকেরই বিচারক হওয়ার যোগ্যতাই ছিল না।
মার্শাল-ল ট্রাইবুনালের নিয়ম অনুযায়ী বিচারক হয় পাঁচ জনকে নিয়ে। এদের একজন হবেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, বাকি চার জন ক্যাপ্টেন।
কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজের মতো করে বিচারক সাজিয়েছিলেন। একজন কমিশনড অফিসার আর বাকি চার জন ছিলেন হাবিলদার ও সিপাহি।
তারা নিজের খেয়াল খুশিমতো রায় দিয়েছে। কোনো রায় সৈনিকদেরকে শোনানো হয়নি।