বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ওসমানী উদ্যানে ৪০ হাজার বর্গফুটের ভবন

  • তরুণ সরকার, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার   
  • ৩ অক্টোবর, ২০২১ ১৮:২০

নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার সংযোগস্থলে একমাত্র ফুসফুস ওসমানী উদ্যান। এই উদ্যানে ভবন নির্মাণের মাধ্যমে মানবিক, স্বাস্থ্য, পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটবে। এটা নীতিনির্ধারকদের দর্শনগত দীনতা।

রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলের প্রধান উন্মুক্ত স্থান ওসমানী উদ্যানে নির্মাণ করা হচ্ছে ৪০ হাজার বর্গফুটের একটি ভবন। এতে ফুডকোর্ট, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, গাড়ি পার্কিং এসব রাখার প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছে, যদিও বারবার এসব পরিকল্পনায় বদল আনা হয়েছে।

নগরবিদরা পার্কে কনক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করে বলছেন, এর মাধ্যমে উদ্যানের মূল চরিত্র নষ্ট করা হচ্ছে।

পার্কে সাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়ে তিন বছর ধরে চলছে ভবন নির্মাণের কাজ। সম্প্রতি কাজ শেষ করার সময়সীমা আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবন নির্মাণের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারকে বাতিল করে বর্তমানে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

ওসমানী উদ্যান তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সংস্কারের অংশ হিসেবে উদ্যানে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।

সিটি করপোরেশন সূত্র মতে, নির্মাণাধীন ভবনটির দৈর্ঘ্য ৫০৩ ফুট এবং প্রস্থ ৭৮ ফুট। ভবনটির আয়তন হবে ৪০ হাজার বর্গফুট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বারবার ডিজাইন পরিবর্তনের পর বর্তমানে ভবনটিতে মূলত ফুডকোর্ট, খেলাধুলার ব্যবস্থা ও লাইব্রেরি রাখার চিন্তাভাবনা করছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।

সংস্কারকাজের জন্য গত সাড়ে তিন বছর ধরে উদ্যানটিতে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ওসমানী উদ্যান সংস্কারকাজ উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। ১০ মাসের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ হবে বলে তখন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। সংস্কার শুরু হওয়ার সময় উদ্যানটিতে জনসাধারণের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর উদ্যান সংস্কার পরিকল্পনায় বারবার পরিবর্তন আনা হয়। বিলম্বিত হয় সংস্কারকাজ।

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নামানুসারে উদ্যানটির নাম ওসমানী উদ্যান করা হয়। মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময় এটির ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ১১ সেক্টরের স্মরণে উদ্যানটিকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। উদ্যানের উল্লেখযোগ্য অংশ তখন কনক্রিটে আচ্ছাদিত করা হয়েছিল।

ওসমানী উদ্যানে ২০১৮ সালে আবার শুরু হয় উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ। মধ্যে ছিল ওয়াকওয়ে, লেক উন্নয়ন, বাউন্ডারি ওয়াল, ল্যান্ডস্ক্যাপিং ওয়ার্ক ইত্যাদি। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ২০১৯ সালে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আসে। তখন উদ্যানে ফুডকোর্ট, মিউজিয়াম, লাইব্রেরি ও খেলাধুলার অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা ও চারপাশের দেয়াল বিলুপ্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় উদ্যানের পশ্চিমে ভবন নির্মাণের।

ওসমানী উদ্যান সংস্কারকাজের বাজেট শুরুতে ছিল ৫৪ কোটি টাকা। এ জন্য বাজেট বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮৯ কোটিতে। ২০২০ সালে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের পর ওসমানী উদ্যান সংস্কার পরিকল্পনায় আবারও পরিবর্তন আসে। পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ওসমানী উদ্যানে ২০০ গাড়ি রাখার মতো আন্ডারগ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিং প্রতিষ্ঠা করা হবে। তখন প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

ওসমানী উদ্যানে ভবনটি নির্মাণ করার মাধ্যমে দেশের প্রচলিত রীতিনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিমত পরিবেশবিদদের। স্থপতি, পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা না করে ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ প্ল্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে উদ্যানের মূল চরিত্র নষ্ট করা হচ্ছে। পার্ক, মাঠে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে গণশুনানি প্রথা রয়েছে। কিন্তু ওসমানী উদ্যানের ক্ষেত্রে এটা মানা হয়নি। পেশাজীবী পরিকল্পনাবিদ, স্থপতিদের সংগঠনের কোনো মতামত নেয়া হয়নি।

পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান আরো বলেন, ফুডকোর্ট, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, গাড়ি পার্কিং এসব পার্কের সঙ্গে যায় না। পার্কের ডিজাইন দেখে মনে হয়, পরিকল্পনা বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে।

আদিল মোহাম্মদ খান আরও বলেন, মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পার্কে র‌্যাব কর্তৃক ভবন নির্মাণের বিরোধিতা করেছেন। একই ঘটনা ওসমানী উদ্যানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ওসমানী উদ্যানে ভবন নির্মাণের বিরোধিতা মেয়রের কাছ থেকে প্রত্যাশা করছি।

তিনি আরও জানান, সম্প্রতি প্লানার্স ইনস্টিটিউট ঢাকার পার্ক ও মাঠ নিয়ে এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। এতে দেখা যায়, ওসমানী উদ্যানের মোট জায়গার প্রায় ৫০ ভাগ কনক্রিটে আচ্ছাদিত করা হয়েছে। এটা খুব উদ্বেগজনক। কারণ গাইডলাইন অনুযায়ী কোনো পার্কে ১০ ভাগের বেশি স্থান কনক্রিটে আচ্ছাদিত হতে পারে না।

প্রকল্পের প্রধান ডিজাইনার স্থপতি রফিক আজম উদ্যানের ৫০ ভাগ আচ্ছাদিত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি জানান, ভবনটি বাগানের মোট আয়তনের ৫ থেকে ৬ ভাগ হতে পারে। ওয়াকওয়ে কী পরিমাণ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। বলতে পারবেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মুন্সী মো. আবুল হাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভবন ও ওয়াকওয়েসহ মোট পরিমাণ প্রায় ১৫/১৬ ভাগ হতে পারে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ওসমানী উদ্যানের উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের পরিকল্পনায় সম্প্রতি আবারও পরিবর্তন এসেছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।

মুন্সী মো. আবুল হাশেম জানান, আন্ডারগ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিং প্রতিষ্ঠা আপাতত করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তিনি আরো জানান, ওসমানী উদ্যানে নির্মাণাধীন ভবনে মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও সম্প্রতি বাদ দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে মিউজিয়াম করা হলে আলাদা ভবন তৈরি করা হতে পারে।

ডিজাইন থেকে মিউজিয়াম বাদ দেয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্পের প্রধান ডিজাইনার স্থপতি রফিক আজম জানান, মিউজিয়াম বাদ দেয়ার বিষয়টি তিনি অবগত নন। এ বিষয়ে তিনি সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলতে বললেন। তিনি আরও বলেন, ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে ওসমানী উদ্যানের নির্মাণকাজ বিলম্বিত হয়েছে। এ ছাড়া ঠিকাদারের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ও সহকারী প্রকল্প পরিচালক তানভীর হাসান জানান, ওসমানী উদ্যান সংস্কার প্রকল্পের ঠিকাদারের নিয়োগ ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। বাতিল করার একটা প্রক্রিয়া আছে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।

সম্প্রতি ওসমানী উদ্যান সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উদ্যানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভবনটি নির্মিত হচ্ছে। এটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। ইতিমধ্যে ভবনটির নির্মাণ দেয়াল পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক তানভীর হাসান বলেন, ‘প্রকল্পের বিভিন্ন কাঠামো তৈরির কাজ প্রায় শেষ। ফিনিশিং দেয়ার কাজ বাকি। আশা করা যাচ্ছে, প্রকল্পের বর্তমান নির্ধারিত মেয়াদ ২০২২ সালের জুন মাসের পূর্বেই সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।’

ওসমানী উদ্যানে ভবন নির্মাণ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কনক্রিটের স্থাপনা বাতিল করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার সংযোগস্থলে একমাত্র ফুসফুস ওসমানী উদ্যান। এই উদ্যানে ভবন নির্মাণের মাধ্যমে মানবিক, স্বাস্থ্য, পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য যে ক্ষতি – সেটা তারা বিবেচনায় আনছে না।

‘এটা নীতিনির্ধারকদের দর্শনগত দীনতা। এ কারণে উদ্যান, পার্ক, নদ-নদী ক্ষতিসাধন করে প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলছে। মাঠ-পার্কে ভবন নির্মাণের দর্শনগত দীনতা থেকে নীতিনির্ধারকদের বের করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় হয় - এমন প্রকল্পের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।’

এ ব্যাপারে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপসের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এ বিভাগের আরো খবর