সাগর ও নদীতে চাহিদামতো ইলিশ না মেলায় মৌসুমের শুরু থেকেই হতাশ ছিলেন জেলে ও ট্রলার মালিকরা। ইলিশ মৌসুমের শেষ দিকে এসে কিছু মাছ মেলায় আশা ফিরেছিল তাদের।
এমন সময় ফের শুরু হচ্ছে সাগরে মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা। সেটিও আবার গত মৌসুমের তুলনায় ১০ দিন আগে। ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞায় যারপরনাই হতাশ জেলে ও ইলিশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই।
বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এ বিষয়ে কথা হয় জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তাদের কথায় উঠে এসেছে ইলিশের এই মৌসুম কেমন ছিল। সঙ্গে এসেছে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাও।
পাথরঘাটার তাফালবাড়িয়া এলাকার মোহাম্মদ ফারুক হোসেন সাগরে ইলিশ ধরছেন প্রায় ৬০ বছর ধরে। তিনি বলেন, ‘এই বচ্ছর সাগরে ইলিশ পাই নাই, যা পাইছি তা জাটকা। এই জাটকা শিকার কইরা কোনো রহম পরানডা বাঁচাইছি। এহন অবরোধ দিছে সরকার, এই অবরোধে পোলা-মাইয়া লইয়া কী খামু, আল্লায় জানে।’
ফারুকের মতো অনেক জেলের অবস্থা এখন একই রকম। তারা জানান, এবার নিষেধাজ্ঞার সময় ১০ দিন এগিয়ে আনায় তাদের যেটুকু আশা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। এখন হতাশাই তাদের সম্বল। কারণ ২২ দিন পর নিষেধাজ্ঞা শেষে ইলিশের ভরা মৌসুম আর থাকবে না।
সরকারি নিষেধাজ্ঞায় বন্ধ ইলিশ ধরা। অলস সময় কাটছে জেলেদের। ছবি: নিউজবাংলা
মাছ ধরার ছয়টি ট্রলারের মালিক পাথরঘাটার আবদুর রহমান। এবারের মৌসুমে তার কোনো লাভই হয়নি। উল্টো আবহাওয়া খারাপ থাকায় জেলেরা নিরাপদে ফিরতে পারবেন কি না, সেই দুশ্চিন্তায় কেটেছে সময়।
আবদুর রহমান বলেন, ‘ছয় ট্রলারে মোট যে ইলিশ পাইছি, হেতে মোর লাভের লাভ কিছু হয় নাই। না নিজে লাভ করতে পারছি, না জেলেদের কিছু দিতে পারছি। আশা ছিল মৌসুমের শেষে কিছু ইলিশ পাওন যাইবে, কিন্তু অবরোধের সময় আগাইয়া দিয়া হেই আশাও মোগো শ্যাষ।’বিএফডিসি আড়তদার সমিতির সভাপতি সাফায়েত মুন্সি বলেন, ‘ব্যবসায় এ বছর লসের পর লস। কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে মাছের ব্যবসায় এবার লস কাটাতে পারেননি আড়তদাররা।
‘এবার শুধু কিছু জাটকা পেয়েছে জেলেরা। এই জাটকায় কী আর ব্যবসা টেকে? আমরা লস কাটাতে পারিনি। মৌসুমও শেষ।’পাইকার সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আব্বাস জানান, ২১ বছরের ব্যবসায় এবার সবচেয়ে কম মাছ এসেছে। এ বছর মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় এগিয়ে আনায় ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রের। মৎস্য বিভাগ কেন, কিসের ভিত্তিতে সময় এগিয়ে এনেছে সেটা তাদের বোধগম্য নয়। তাদের ক্ষতির পাশাপাশি রাষ্ট্রও ক্ষতির মুখে পড়ল।
গত বছরের তুলনায় এবার অবশ্য এই কেন্দ্রে মাছ বেশি এসেছে। তবে অধিকাংশই জাটকা হওয়ায় দাম পাননি জেলেরা।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে জানা যায়, ২০২০-২১ মৌসুমে বিএফডিসি আড়তে ১ হাজার ২১৯ টন ইলিশ এসেছে। তবে তার ৮৫ থেকে ৯০ ভাগই ছিল জাটকা সাইজের ইলিশ। সেপ্টেম্বরে আসা ৭০৪ টনের ৯০ শতাংশ ছিল ছোট আকৃতির মাছ।
বিএফডিসি পাথরঘাটার ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট লুৎফর রহমান বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় ২০০ টন ইলিশ বেশি অবতরণ হয়েছে, কিন্তু এর বেশির ভাগ ছিল জাটকা। ফলে দাম পাননি জেলেরা। আর লাভবান হতে পারেননি মৎস্যজীবীরা।
জেলেদের পাশাপাশি বিপাকে ঘাটশ্রমিকরা
মাছ কম পাওয়ার পাশাপাশি দামও না থাকায় জেলেদের পাশাপাশি বিপাকে পড়েছেন বিএফডিসি কেন্দ্রে থাকা শ্রমিকরা।
পাথরঘাটার এই কেন্দ্রে কাজ করেন ৭১০ জন ঘাটশ্রমিক। সকাল থেকে তারা বসে থাকেন কখন ট্রলার ভিড়বে। যত ঝাঁপি মাছ ট্রলার থেকে তুলবেন, তত টাকা পাবেন।
এই ঘাটশ্রমিকদের সভাপতি ফারুক আকন। তিনি বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকদেরও এবার রুটি রুজি জোটে না। অবরোধে জেলেরা কিছু খাদ্য সহায়তা পেলেও শ্রমিকদের দেয়া হয় না কিছুই। মাছ বেশি তো আমাদের সবারই আয়। মাছ নেই আমাদেরও পেটে ক্ষুধা। ২২ দিন অনাহার-অর্ধাহারে কাটাতে হবে।’
ভারতীয় জেলেদের ঠেকানোর দাবি
সাগরে ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর দাবি জানিয়েছেন এ ঘাটের মৎসজীবীরা।
জেলেদের অভিযোগ, প্রতিবছর নিষেধাজ্ঞা চলার সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের পানিসীমায় ঢুকে ইলিশ মাছ শিকার করে নিয়ে যায়।
উপকূলীয় ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী এ বিষয়ে জানান, বাংলাদেশে ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা শুরু হলেও ভারতে এই সময় নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। ফলে সহজেই তারা এসে মাছ ধরে নিয়ে যেতে পারবে। আর মাছ ধরতে না পেরে বাংলাদেশের জেলেরা অনাহারে-অর্ধাহারে থাকবে। একই সময়ে দুই দেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে সবাই লাভবান হবে।
তিনি বলেন, ‘ভরা মৌসুমে ইলিশ না পেয়ে হাজার হাজার জেলে খালি হাতে ফিরেছে। কারণ তার আগেই ভারতীয় জেলেরা ইলিশ ধরে নিয়ে যায়। এবারও সাগরে মাছ নেই।
‘৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর গত ২৪ জুলাই থেকে সাগরে মাছ ধরা শুরু হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ জেলেই মাছ পায়নি। জাল ফেললেই এখন ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়ার কথা। এত মাছ কোথায় গেল বা কারা ধরে নিয়ে গেল, তা আমরা বুঝতে পারছি না।’
ভারতীয় জেলেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কিছু সত্যতা মেলে কোস্ট গার্ডের তথ্যেও।
কোস্ট গার্ড সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচটি ট্রলারসহ ভারতের ৭৪ জেলেকে আটক করেছে বাহিনীটি। এসব ট্রলার বাংলাদেশের সীমানায় এসে মাছ ধরছিল।
জেলেদের অভিযোগ, এই সংখ্যা অনেক। ভারতের অনেক ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় এসে মাছ ধরে। তবে কোস্ট গার্ড জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের ধরতে পারে না।
কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমিরুল হক বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে আসছি অনুপ্রবেশ বন্ধে। বিভিন্ন সময় ভারতীয় জেলেদের আটক করা হয়েছে। অবরোধের সময় যেকোনো জেলের ইলিশ শিকার বন্ধে কোস্ট গার্ড তৎপর রয়েছে।’ জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, বরগুনা জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৭৪ জন। নিষেধাজ্ঞার সময় তাদের সহায়তার জন্য ৭৪১.৪৮ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।