বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন এ খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি জানান, পশ্চিমা ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। পোশাকের আরও বেশি দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে।
কারখানাগুলোকে কম দামে অর্ডার না নেয়ার আহ্বানও তিনি জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। প্রচুর অর্ডার আসছে। পোশাকের দামও বাড়ছে। সেইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা পাওয়ার পথও সুগম হয়েছে। সবমিলিয়ে মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও পোশাক শিল্পে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে, তা ধরে রাখতে পারব বলে আশা করছি।’
এক মাস যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর শেষে দেশে ফিরে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এই সুসংবাদ দিয়েছেন ফারুক হাসান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি (শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা) ফেরত পাওয়া সহজ হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরে আমরা বড় বড় বায়ারদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা আমাদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পোশাক কিনবেন তারা। আরও বেশি প্রাইস (দাম) দেবেন।
‘এ বিষয়ে আমি আমাদের পোশাক শিল্প মালিকদের আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এখন আর কম দামে অর্ডার না নেন। যদি আমরা সবাই মিলে প্রাইসের ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে থাকি, তাহলে তা আরও বাড়বে। আর সেটা ধরে রাখতে পারলে আমরা লাভবান হব।’
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, পোশাকখাত আমাদের গর্ব। এই খাতকে ঘিরে আছে কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। আগামী দিনে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ভিশন তৈরি করেছে, তা অর্জনে পোশাকখাতের গুরুত্ব অপরীসিম। আমাদের সম্ভাবনাও অনেক।
‘গত দেড় বছর কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে আমরা অনেকটাই অবরুদ্ধ ছিলাম। অথচ বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের অংশ হিসেবে আমাদেরকে নিয়মিতভাবে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসতে হয়, তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়, শিল্প ও অর্থনীতি কোথায় আছে, সর্বশেষ পরিস্থিতি কী, তা তাদের জানাতে হয়। সেই তাগিদ থেকে আমরা আমাদের রপ্তানি বাজারে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছি।
‘সেই উপলব্ধি থেকেই গত এক মাস আমরা অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসির উদ্যোগ হিসেবে আমাদের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেছি। এ সফরে আমার সঙ্গে ছিলেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বর্তমান বোর্ডের সহ-সভাপতি মিরান আলী ও পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব।’
‘সেখানে ফ্যাশন সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, বিশেষ করে ক্রেতা ও ব্র্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন প্রতিনিধিসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা, গণমাধ্যম, একাডেমিয়া, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং সেসব দেশে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি, অনেক সভায় অংশগ্রহণ করেছি। শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় এবং দেশ ও অর্থনীতি, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলেছি।’
তিনি বলেন, ‘আজ আমি দেশবাসীকে একটি সুসংবাদ দিতে চাই। আর সেই সুংবাদটি হচ্ছে, আমাদের অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসির। ইউরোপ বাংলাদেশের প্রধান বাজার, যেখানে আমাদের মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশ রপ্তানি হয়। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের মাধ্যমে এই বাজারটিতে আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় পরিবর্তন আসবে।
‘যদিওবা বর্তমান সুবিধা ২০২৯ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, এর পরও যেন আরও অন্তত ১২ বছর এই সুবিধা (ইবিএ) বহাল রাখা হয় তার জন্য সরকার এবং বিজিএমইএ একসঙ্গে কাজ করছে।’
এক মাস যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান
ফারুক হাসান বলেন, “আমরা ইবিএ পরবর্তী শুল্কসুবিধা ’জিএসপি প্লাস’ এর বিষয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ প্রতিনিধি এবং ব্রাসেলসে একাধিক বৈঠক করেছি, বিশেষ করে জিএসপি প্লাসের একটি অন্যতম শর্ত ৭.৪% ইম্পোর্ট থ্রেশহোল্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া বা এর বিকল্প ফর্মুলা প্রবর্তনের অনুরোধ করেছিলাম। আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রস্তাবিত ২০২৪-২০৩৪ জিএসপি রেগুলেশনে এই ইম্পোর্ট থ্রেশহোল্ড শর্তটি বাদ দিয়েছে।
‘ফলে আমরা যখনই ইবিএ সুবিধা হারাই না কেন, জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে আর বড় কোনো বাধা থাকল না। আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তাদের এই পদক্ষেপের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।বিশেষ করে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত রেনশে টেরিংকে। এ বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আমাদের অনেক সভা হয়েছে এবং আমাদের বক্তব্যটি ইউরোপীয় কমিশনে তুলে ধরতে তার অবদান অনেক।’
স্বল্প আয় ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০১৫ সালে ‘স্পেশাল ইনসেনটিভ অ্যারেঞ্জমেন্ট ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’শীর্ষক একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা চালু করে। যা ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত। এই সুবিধার আওতায় ইউরোপের বাজারে ট্যারিফ লাইনের ৬৬ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। বর্তমানে মাত্র আটটি দেশ ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা পাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এ সুবিধা পেত। তবে সম্প্রতি ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানের এই সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইইউ।
পোশাকের ন্যায্য মূল্য এবং ইথিক্যাল সোর্সিং নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে বিজিএমইএ প্রধান বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে কারখানা রিমেডিয়েশন এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে হয়েছে। কোভিডের মধ্যে কারখানা খোলা রেখে আমরা কেবল ব্যবসা ধরে রেখেছি, কিন্তু এর পেছনে প্রতিটি কারখানা কতটা ত্যাগ স্বীকার করে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে সেটিও দেখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে আমাদের বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, 'জিএসপি ফেরত না পাওয়ার কারণটা রাজনৈতিক। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭ শতাংশ পণ্যে উন্নত দেশগুলো শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিতে বাধ্য। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র সুকৌশলে ওই ৯৭ শতাংশ পণ্যের মধ্যে আমাদের তৈরি পোশাক খাতকে রাখে নাই। তারপরও সফরে এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।'
সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম, মিরান আলী, পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিবসহ অন্য পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।