রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ হত্যায় মর্মাহত যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিনকেন।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ বার্তা প্রকাশ করা হয়।
অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের বিবৃতিতে বলা হয়, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান করে জঘন্য ওই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটেও ব্লিঙ্কেনের এই বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।
গত বুধবার রাতে এশার নামাজ শেষে উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পে নিজের অফিসে বসে ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। সেখানেই হাজির হয় ২০-২৫ জনের একটি সশস্ত্র দল। মুহিবুল্লাহর বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায় তাদের একজন। প্রায় বিনা বাধায় রোহিঙ্গাদের প্রভাবশালী এই নেতাকে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা।
এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক মর্মাহত করেছে জানিয়ে অ্যান্থনি ব্লিনকেন বলেন, ‘সারা বিশ্বে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষায় মুহিবুল্লাহ ছিলেন সাহসী ও শক্তিশালী প্রচারক। তিনি জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের পাশাপাশি ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ধর্মীয়ভাবে নিপীড়িত হওয়া জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিলেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘জঘন্য ওই অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে আমরা তার হত্যার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানাই। আমরা রোহিঙ্গাদের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রেখে এবং রোহিঙ্গারা নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে যাতে উচ্চকণ্ঠ হতে পারে, সেজন্য সহায়তার মাধ্যমে তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব।’
ব্লিনকেন তার টুইটে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। সারা বিশ্বে রোহিঙ্গাদের পক্ষে একজন সাহসী নেতা হিসেবে তিনি বেঁচে থাকবেন।’
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ। ছবি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
হত্যার পেছনের কারণ
২০১৮ সালে রোহিঙ্গা আগমনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে এই মুহিবুল্লাহর ডাকেই বালুখালির এক্সটেনশন মাঠে সমাবেত হয়েছিলেন প্রায় পাঁচ লাখ নারী-পুরুষ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে হওয়া ওই সমাবেশের খবর ফলাও করে প্রচার করেছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
সমাবেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন মুহিবুল্লাহ। এর প্রথমেই ছিল মিয়ানমারের আরাকানের পিতৃভূমিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন। তবে শর্ত ছিল, এ জন্য অবশ্যই মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের হারানো সম্মান, মর্যাদা ও নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে।
মুহিবুল্লাহর এই দাবি সাধারণ রোহিঙ্গাদেরও প্রাণের দাবি। এ কারণে মুহিবুল্লাহকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেন তারা।
এই সমাবেশ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও মিয়ানমার সরকারের জন্য বিব্রতকর ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে এটি মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের নতুন রাস্তা খুলে দেয় পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘের কাছে।
২০১৮ সালের ওই সমাবেশের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে সব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা ও পশ্চিমা বিশ্বের আস্থার স্থল হয়ে ওঠেন মুহিবুল্লাহ।
মুহিবুল্লাহর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রকাশিত হতে থাকে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখতে আসা বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন মুহিবুল্লাহ।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার সরকারের জন্য এক চাপের নাম হয়ে উঠেছিলেন মুহিবুল্লাহ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারের চালান অমানবিক হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরতেন তিনি।
এ ছাড়া, বিভিন্ন ফোরামেও রোহিঙ্গাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতেন মুহিবুল্লাহ।
একাধিক রোহিঙ্গা নেতা নিউজবাংলাকে জানান, মুহিবুল্লাহর স্বর ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী, সরকার ও তাদের মিত্রদের জন্য বিব্রতকর। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্যও তিনি ছিলেন অস্বস্তির কারণ। বিশেষত, যেসব সংগঠন প্রত্যাবাসনবিরোধী ছিল। এদের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) বা আল ইয়াকিন অন্যতম।
রোহিঙ্গা নেতাদের বিশ্বাস, এই সন্ত্রাসী সংগঠনের কারণেই তাদের পিতৃভূমি ছাড়তে হয়েছে। এরা মিয়ানমার সরকারেরই পুতুল সংগঠন। মূলত কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় এই ছায়া সংগঠন দাঁড় করায় মিয়ানমার। পরে তাদের মাধ্যমে সীমান্তচৌকিতে হামলার নাটক করে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ত্যাগে বাধ্য করে।
এ সময় ৩ রাউন্ড গুলি তার বুকে লাগে। এতে তিনি ঘটনাস্থলে পড়ে যান। খবর পেয়ে এপিবিএন সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে ‘এমএসএফ’ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।