কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে আটক করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)।
এপিবিএন-১৪-এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নইমুল হক নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালে কুতুপালংয়ের ৬ নম্বর ক্যাম্প থেকে এপিবিএন সদস্যরা তাকে আটক করেন।
আটক ব্যক্তির নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি এসপি নইমুল। তিনি জানান, আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তথ্য পাওয়ার পর বিস্তারিত জানানো হবে।
বুধবার রাত পৌনে ৯টার দিকে উখিয়া কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় ইস্ট-ওয়েস্ট ১ নম্বর ব্লকের অফিসে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এ ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পজুড়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত এপিবিএন অধিনায়ক নাইমুল হক তখন জানিয়েছিলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জড়িতদের আটকে অভিযান চলছে।
বর্তমানে ক্যাম্প এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
নিহত ৫০ বছর বয়সী মুহিবুল্লাহর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু এলাকার লংডা ছড়া গ্রামে। তিনি রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে মংডু টাউনশিপের সিকদার পাড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে উখিয়া কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে আসেন।
মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে কাজ করছিলেন তিনি। এটাই মুহিবুল্লাহর ‘অপরাধ’ বলে মনে করেন তার ছোট ভাই ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হাবিব উল্লাহ।
যারা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গ্রুপ আরএসও-এর সদস্য বলে দাবি হাবিবের।
ভাই হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে উখিয়া থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের নামে মামলা করেন। সেই মামলার ২৪ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই সন্দেহভাজন একজনকে আটক করল পুলিশ।
হত্যার পেছনের কারণ
২০১৮ সালে রোহিঙ্গা আগমনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে এই মুহিবুল্লাহর ডাকেই বালুখালির এক্সটেনশন মাঠে সমাবেত হয়েছিলেন প্রায় পাঁচ লাখ নারী-পুরুষ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে হওয়া ওই সমাবেশের খবর ফলাও করে প্রচার করেছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
সমাবেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন মুহিবুল্লাহ। এর প্রথমেই ছিল মিয়ানমারের আরাকানের পিতৃভূমিতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন। তবে শর্ত ছিল, এ জন্য অবশ্যই মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের হারানো সম্মান, মর্যাদা ও নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে।
মুহিবুল্লাহর এই দাবি সাধারণ রোহিঙ্গাদেরও প্রাণের দাবি। এ কারণে মুহিবুল্লাহকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেন তারা।
এই সমাবেশ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও মিয়ানমার সরকারের জন্য বিব্রতকর ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে এটি মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের নতুন রাস্তা খুলে দেয় পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘের কাছে।
২০১৮ সালের ওই সমাবেশের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে সব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা ও পশ্চিমা বিশ্বের আস্থার স্থল হয়ে ওঠেন মুহিবুল্লাহ।
মুহিবুল্লাহর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রকাশিত হতে থাকে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখতে আসা বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন মুহিবুল্লাহ।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার সরকারের জন্য এক চাপের নাম হয়ে উঠেছিলেন মুহিবুল্লাহ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারের চালান অমানবিক হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরতেন তিনি।
এ ছাড়া, বিভিন্ন ফোরামেও রোহিঙ্গাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতেন মুহিবুল্লাহ।
একাধিক রোহিঙ্গা নেতা নিউজবাংলাকে জানান, মুহিবুল্লাহর স্বর ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী, সরকার ও তাদের মিত্রদের জন্য বিব্রতকর। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্যও তিনি ছিলেন অস্বস্তির কারণ। বিশেষত, যেসব সংগঠন প্রত্যাবাসনবিরোধী ছিল। এদের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) বা আল ইয়াকিন অন্যতম।
রোহিঙ্গা নেতাদের বিশ্বাস, এই সন্ত্রাসী সংগঠনের কারণেই তাদের পিতৃভূমি ছাড়তে হয়েছে। এরা মিয়ানমার সরকারেরই পুতুল সংগঠন। মূলত কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় এই ছায়া সংগঠন দাঁড় করায় মিয়ানমার। পরে তাদের মাধ্যমে সীমান্তচৌকিতে হামলার নাটক করে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ত্যাগে বাধ্য করে।