বিদেশে এক যুগের বেশি সময় কর্মজীবন কাটিয়ে অবসর নেয়া সত্তরোর্ধ্ব নাদিরা বেগমের (ছদ্মনাম) আশ্রয় এখন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রবীণ নিবাস। একসময় তার আয়ে চলত গোটা ছয় সদস্যের পরিবার। এখন পরিবারের লোক যে যার মতো ব্যস্ত থাকায় নিঃসঙ্গ নাদিরার সময় কাটে প্রবীণ নিবাসের আবদ্ধ ঘরে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে ১৮ মাস নাদিয়ার সঙ্গে দেখা করেন না পরিবারের সদস্যরা। প্রতি মাসে বিকাশে করে নিবাসের টাকা পরিশোধ করেন তার বড় ছেলে। তবে প্রবীণ নাদিরার আক্ষেপ, শেষ বয়সে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কোনো দিনও ভাবেননি। এই ভেবেই সারা দিন কাটে তার বিষণ্নতায়। কমে এসেছে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা; দেখা দিয়েছে ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতা। তার অভিযোগ, সময়মতো নিবাসের খরচ পরিশোধ করলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। দেখা দিচ্ছে অপুষ্টি।
শুধু নাদিরা নন, নাদিরার মতো পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন লাখও প্রবীণ। সম্প্রতি প্রবীণদের পুষ্টিহীনতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) করা এক গবেষণায় এর প্রমাণও মিলছে।
গবেষণা বলছে, দেশে যত প্রবীণ রয়েছে তার এক-চতুর্থাংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। আরও সহজভাবে বললে প্রতি ১০০ জন প্রবীণের মধ্যে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন ২৫ জন। আর পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন অর্ধেকেরও বেশি প্রবীণ।
করোনার মধ্যে নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্নতার কারণে প্রবীণদের মধ্যে পুষ্টিহীনতার সংখ্যা আরও বেড়েছে। পুরুষের তুলনায় অপুষ্টিতে ভোগা নারী প্রবীণের সংখ্যা বেশি। এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে আজ, ১ অক্টোবর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ২০২১।
চিকিৎসকরা বলছেন, বিষণ্নতা থেকে অপুষ্টিতে ভুগছেন প্রবীণরা। ফলে কমে আসছে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রমণ রোগ বেশি দেখা দিচ্ছে প্রবীণদের। এমনকি প্রবীণদের কোয়ালিটি অফ লাইফও থাকছে না। তাদের অন্যের ওপরে ভরসা করে জীবন পার করতে হচ্ছে।
দেশের প্রবীণরা কী কী কারণে অপুষ্টিতে ভোগেন তা খুঁজতেই মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাটি চালায়। ঢাকার উত্তরখান উপজেলার মুন্ডা, পোলারটেক ও ভাটুলিয়া গ্রামের ১২৫ জন প্রবীণের মাঝে এই গবেষণা চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগ।
গবেষণা বলছে, দেশে পুষ্টিহীনতার মাত্রা ক্রমেই কমছে। আর এই মাত্রা প্রবীণদের মাঝে উদ্বেগজনক। দেশে বর্তমানে এক-চতুর্থাংশ প্রবীণই ভুগছেন অপুষ্টিতে। সেই সঙ্গে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন অর্ধেকের বেশি প্রবীণ জনগোষ্ঠী।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ ষাটোর্ধ্ব। এর মধ্যে অপুষ্টিতে ভুগছেন ২ শতাংশ প্রবীণ। বিশ্বে অন্যদের তুলনায় প্রবীণদের (ষাটোর্ধ্ব) মধ্যে অপুষ্টি বা পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বেশি।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবীণের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০৫০ সালে যা সাড়ে ৩ কোটিতে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গবেষণায় বলা হয়, শিক্ষার অভাব, বিষণ্নতা, মুখ ও দাঁতের খারাপ স্বাস্থ্য, বিশেষ খাদ্য পরিহারের অভ্যাস এবং অসংক্রামক রোগের উপস্থিতি পুষ্টিহীনতায় ভোগার প্রধান কারণ। আর এতে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি ভোগেন। প্রবীণ পুরুষদের অপুষ্টিতে ভোগার হার যেখানে ২২ শতাংশ, সেখানে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ভোগেন পুষ্টিহীনতায়।
গবেষণায় এও দেখা যায়, জীবনসঙ্গীবিহীন (বিধবা, বিপত্নীক, অবিবাহিত) প্রবীণদের মাঝে অপুষ্টির হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ ও পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বিষণ্নতায় ভোগা প্রায় ৪০ শতাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন। স্বাভাবিকের তুলনায় বিষণ্নতায় ভোগা প্রবীণদের অপুষ্টিতে ভোগার সম্ভাবনা ১৫ দশমিক ৬ গুণ বেশি।
এমন অবস্থায় প্রবীণদের অপুষ্টি দূর করতে পুষ্টিবিষয়ক সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি নারীদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলছেন গবেষকরা। প্রবীণদের সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে তাদের মানসিক ও মুখের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে জোর দেয়া এবং তাদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস নিশ্চিত করা জরুরি মনে করেন গবেষকরা।
গবেষণা দলের প্রধান গবেষক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে এম তৌহিদুর রহমান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, যারা প্রবীণ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তারা অপুষ্টিতে বেশি ভোগেন। সেই সঙ্গে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তারাও অপুষ্টিতে ভুগছেন বেশি। কারণ এসব শ্রেণির মানুষের পুষ্টি বিষয়ে তেমন ধারণা নেই। এ ছাড়া অনেক সচেতন থাকলেও টাকার অভাবে দেহে পুষ্টি বাড়াতে পারেন না।
এ অবস্থায় করণীয় জানতে চাইলে এই গবেষক বলেন, পুষ্টিহীনতায় ভোগা প্রবীণদের অধিকাংশই প্রান্তিক অঞ্চলের। এই জনগোষ্ঠীর পুষ্টিহীনতা দূর করতে সচেতনতামূলক কর্মশালা প্রয়োজন। প্রবীণদের নারীদের অপুষ্টিতে ভোগার পরিমাণ অনেক বেশি। যে কারণে তাদের বিষয়ে এলাকা গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি রাখা উচিত। সেই সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয়ভাবে প্রবীণদের বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে।
তৌহিদুর বলেন, ‘এখানে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ওনারা আমাদের দেশে বড় একটি জনগোষ্ঠী। সমাজ গঠনে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ওনাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে না পারলে তাদের পুষ্টির সমস্যা সমাধান হবে না। পুষ্টিহীনতায় ভোগার কারণে তাদের দেহে অন্যান্য রোগগুলো বেশি দেখা মিলছে। এর মধ্যে কিডনি, হৃদরোগ বেশি দেখা মিলছে। তাদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস নিশ্চিত করতে হবে।’
এই চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি মানসিক বিপর্যয়ে ছিলেন প্রবীণরা। এমন পরিস্থিতিতে থাকার কারণে বলাই যায়, করোনা সংক্রমণের কারণে প্রবীণদের মানসিক সমস্যার এই হার আরও বেড়েছে।