আলুর বাজার দর নিম্নমুখী হওয়ায় জয়পুরহাটের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। হিমাগারে মজুদ প্রতি বস্তা আলুতে তাদেরকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানান, প্রকারভেদে ৬০ কেজির প্রতি বস্তা হিমায়িত আলু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। অথচ হিমাগারে মজুদের খরচসহ এসব আলুতে বস্তাপ্রতি খরচ পড়েছে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা।
আলুর দামের মন্দাবস্থা কাটাতে সরকারি উদ্যোগে বিদেশে রপ্তানি ছাড়াও টিসিবি অথবা টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে আলু সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন কোল্ড স্টোর অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। এই দাবিতে তারা বগুড়ার জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
আলুর এমন মন্দাবস্থা থাকলেও আসন্ন মৌসুমে উৎপাদনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে দাবি কৃষি বিভাগের।
খাদ্যে উদ্বৃত্ত জয়পুরহাট জেলায় গত মৌসুমে ৪০ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমি থেকে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টন। গত বছর হিমায়িত আলুতে লাভের পর এবার জেলার ১৭টি হিমাগারে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টন আলু মজুদ করেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। ৬০ কেজি হিসাবে যার পরিমাণ ২৬ লাখ বস্তা।
এবার অ্যাস্টেরিক জাতের ৬০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা আলু সংরক্ষণে খরচ পড়েছে এক হাজার টাকা আর দেশি জাতের লাল গুটি আলুতে খরচ পড়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকা। তবে বর্তমানে অ্যাস্টেরিক জাতের প্রতি বস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর দেশি গুটি আলু বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়।
এতে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আলুর মজুদ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন হিমাগার মালিকরাও। এখনও জেলার প্রতিটি হিমাগারে সংরক্ষণের অর্ধেকের বেশি আলু মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
কোনো কোনো হিমাগারে সংরক্ষণ করা আলুর বিপরীতে ঋণও দেয়া হয়েছে। বর্তমান বাজার অনুযায়ী আলু বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়া আর ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী আলু নিতে দেরি করছেন বলে অভিযোগ হিমাগার মালিকদের।
কৃষক ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গত বছর আলুর দাম বেশি হওয়ায় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে কম দামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য করেছিলেন। তবে এবার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আলু নিয়ে বিপাকে পড়লেও সরকারের কোনো নজরদারি নেই। বিদেশে রপ্তানির পাশাপাশি টিসিবি, টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগে আলু সরবরাহ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার বেলগাড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুল আলিম জানান, আসন্ন মৌসুমে রোপনের জন্য তিনি ১০০ বস্তা অ্যাস্টেরিক জাতের আলু স্থানীয় মোল্লা হিমাগারে সংরক্ষণ করেছেন। ৬০ কেজির প্রতি বস্তা আলু সংরক্ষণে তার খরচ হয়েছে ১ হাজার ২০ টাকা। এখন সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকায়। বিশাল এ লোকসান কাটিয়ে আসন্ন মৌসুমে কীভাবে আলু রোপনের খরচ জোগাবেন সেই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
জেলার কালাই উপজেলার মোলামগাড়ি বাজারের আলু ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান বলেন, ‘গত বছর কেজি প্রতি ১৭ টাকা দরের আলু সরকার ২৩ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করেছিলেন। অথচ দাম উঠেছিল ৩৫ টাকা। আর এবার ১৮ টাকা দরের আলু বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ৯ টাকায়। সরকার এখন নজর দিচ্ছেন না কেন?’
দাম কমে যাওয়ায় আলু নিয়ে এমন ক্ষোভ ও দুশ্চিন্তা জেলার অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও কৃষকের।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কালাই উপজেলার ‘নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজে’ এই বছর কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আলু সংরক্ষণ করেছেন ১ লাখ ৭০ হাজার বস্তা। যার মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত কৃষক ও ব্যবসায়ীরা নিয়েছেন মাত্র ৫৯ হাজার বস্তা।
ক্ষেতলালের ‘হাফিজার রহমান বীজ হিমাগারে’ কৃষকরা এ বছর আলু সংরক্ষণ করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার বস্তা। এ পর্যন্ত নেয়া হয়েছে ৭০ হাজার বস্তা। একইভাবে ‘কাথাইল গোপীনাথপুর পল্লী হিমাগারে’ ১ লাখ ১৮ হাজার বস্তা সংরক্ষণ হলেও নেয়া হয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার বস্তা। একই অবস্থা জেলার অন্যান্য হিমাগারগুলোতেও।
আলুর মজুদ নিয়ে মোলামগাড়ি নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আলুর দাম না থাকায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু নিতে আসছেন না। ফলে এবার সংরক্ষণের অর্ধেকেরও বেশি আলু হিমাগারে মজুদ রয়েছে। এসব আলু সংরক্ষণের সময়সীমা রয়েছে আর দুই মাস। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে হিমাগার খালি করতে হবে, কিন্তু আদৌ সেটা সম্ভব হবে কি না জানি না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক বাবলু কুমার সুত্রধর বলেন, ‘বাজারে আলুর দাম কম হলেও আসন্ন মৌসুমে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।’
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আলু আর ধান, জয়পুরহাটের প্রাণ। লোকসান হলেও জয়পুরহাটের কৃষকরা আলু আর ধান রোপন থেকে কখনও বিমুখ হবেন না। এ জেলার অতীত রেকর্ড তাই বলে।’