রুটি বানানো কঠিন কাজ। তাই ফেসবুকে প্রস্তুত করা সুদৃশ্য আটার রুটির ছবি দেখে আকৃষ্ট হন রুহুল আমিন। পুরান ঢাকার ঠিকানা দেয়া একজন উদ্যোক্তা রুটি বানিয়ে বিক্রি করেন। অর্ডার দেয়ার তিন দিন পর হাতে রুটি পেলেন রুহুল। কিন্তু সেঁকে খাওয়ার সময় রুটি থেকে দুর্গন্ধ। অর্থাৎ অনেক দিন আগে বানিয়ে রাখা রুটি নষ্ট হয়ে গেছে।
ফেসবুকের ওই পেজে পুরো ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেয়া ছিল না। তাই রুহুল আমিন মেসেঞ্জারে রুটির গন্ধের বিষয়ে জানতে চান। পরে পেজটি থেকে নতুন করে রুটি দেয়ার আশ্বাস দেয়া হলেও রাখা হয়নি সেই প্রতিশ্রুতি।
ফেসবুকভিত্তিক পণ্য বিক্রি বা ‘এফ-কমার্স’ ব্যবসায় ভোক্তা সেবা নিয়ে বাড়ছে অনিয়মের অভিযোগ। যেসব অভিযোগ সাধারণত ই-কমার্সের ক্ষেত্রে উঠতে দেখা যায়, সেগুলো থেকে মোটেও মুক্ত নয় এফ-কমার্সও।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা জানান, ‘পণ্য বিক্রি এবং মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনও দুর্বলতা আছে। ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স কর্মকাণ্ডে ঠকছেন ক্রেতা। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা পেজগুলোতে উৎপাদনকারীর নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেয়া থাকে না। ফলে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিলেও ব্যবস্থা নেয়া যায় না।’
বেসিস-এর সাবেক সভাপতি ফাহিম মাসরুর মনে করেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ তদারকিতে এই ব্যবসা পরিচালত হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, জনগণের অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে সম্ভাবনাময় এই খাত মুখ থুবড়ে পড়বে।
এফ-কমার্সে তিক্ত অভিজ্ঞতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নুসরাত জাহান ফেসবুকের একটি পেজে ছবি দেখে ২ হাজার ৫০০ টাকার একটি ড্রেস অর্ডার করেন। মেসেঞ্জারে জানানো হয়, ডেলিভেরির আগে টাকা পরিশোধ করতে হবে। তিনি ফেসবুক পেজে দেয়া মোবাইল নম্বরে বিকাশ করে দেন। কিন্তু ডেলিভারির পর দেখা যায়, ছবি দেখিয়ে তিনি যে ড্রেস অর্ডার করেছেন, সেটা তাকে দেয়া হয়নি। এমনকি তিনি যে ড্রেসটি পেয়েছেন, সেটা নিম্নমানের। মেসেঞ্জারে বিষয়টি জানানো হলে সরবরাহকারী বলেন, যেটা অর্ডার করা হয়েছে সেটাই তারা পাঠিয়েছেন।
ফেসুবকের একটি পেজে মেয়েদের টপস, প্লাজো, নাইটিসহ বিভিন্ন পণ্য দেখে পছন্দ করেন রায়হানা শামস। মেসেঞ্জারে পছন্দের পণ্যের ছবি দেখিয়ে অর্ডার দিলে পাওয়া যাবে কি না জানতে চান। উত্তরে জানানো হয়, ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে। পছন্দের পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা দিলেই হবে। কিন্তু অর্ডার করার সময় কিছু টাকা দিতে হবে। একটি বিকাশ নম্বরও দেন তারা।
রায়হানা মেয়েদের দুটি টপস ও দুটি প্লাজো অর্ডার দেন। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে ৪০০ টাকা বিকাশ করেন তিনি। কিন্তু প্রায় দুই মাস পার হলেও এখনও অর্ডার করা পণ্য পাওয়া যায়নি। কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে ২/৩ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেয়া হবে বলে একাধিবার আশ্বস্ত করা হলেও কাঙ্ক্ষিত পণ্য বা টাকা কোনোটাই পাওয়া যায়নি।
ভোক্তায় বাড়ছে অভিযোগ
অনলাইন ব্যবসায় ঠকলেই প্রতিকারের একমাত্র জায়গা এখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সকাল থেকে সন্ধ্যা– বলা যায় সারা দিনই এই ব্যবসা নিয়ে জমা পড়ছে অভিযোগ।
৩১ আগস্ট পর্যন্ত পণ্য না পাওয়ার কারণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে ৪ হাজার ৯৮২টি। ফেসবুক পেজে পণ্য দেয়ার কথা বলে আর দেয়া হয়নি, অথবা পেজে যে পণ্যের ছবি দেয়া হয়, সেই পণ্য না পাওয়ায় অভিযোগ করা হয়।
এ পর্যন্ত ৪ হাজার ২৮৮টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তবে অনেক অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ পেজে পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর ঠিকানা এবং ফোন নম্বরের অনুপস্থিতি। ফলে ভোক্তা প্রতারিত হলেও পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকারের এই সংস্থা।
কে করবে নজরদারি?
পূর্ণাঙ্গ আইন না থাকায় বাংলাদেশে ইচ্ছেমতো চলছে অনলাইন ব্যবসা। বিদ্যমান ই-কমার্স নীতিমালায় অনেকটাই উপেক্ষিত হচ্ছে ক্রেতা সুরক্ষার দিক। ক্রেতার স্বার্থ সুরক্ষায় এবং বিক্রেতাদের পেমেন্ট সুরক্ষা– দুই ক্ষেত্রেই আইনি ব্যবস্থা নেই এখনও। ২০১৮ সালের নীতিমালা অনুযায়ী ক্রেতা প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিদপ্তরে যেতে পারেন। তবে তা যথেষ্ট নয়।
২০২০ সালের বেসরকারি হিসাব বলছে, ওই বছর ই-কমার্স খাতে ব্যবসার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ে এ ব্যবসা বেড়েছে ৩০০ গুণ।
ভারত ও চীনে পৃথক আইনের অধীনে রয়েছে পৃথক নীতিমালা ও কমিশন। সেই কমিশন ই-কমার্স ব্যবসা মনিটরিং করে থাকে ভোক্তা সুরক্ষায়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ১০ শতাংশ ক্রেতা। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ১০ কোটির বেশি মানুষ। করোনাকালে দেশে বেড়েছে অনলাইন ব্যবসার প্রসার। বাজার বড় হওয়ার ফলে দেশে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে আলীবাবা, অ্যামাজন, গুগল ও ফেসবুকের মতো ই-জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান। ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের করও দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।
আইন করা নিয়ে ধূম্রজাল
বিদ্যমান ই-কমার্স নীতিমালার অধীনেই দেশের ই-কমার্স এবং এফ-কমার্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হবে, নাকি শক্ত কোনো আইন করা হবে, যেখানে পৃথক তদারকি সংস্থা এবং শাস্তির বিধান করা হবে?
ই-কমার্স নিয়ে সাম্প্রতিক নানান অনিয়মের পর এই ব্যবসায় শৃঙ্খলা আনতে আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এতে আপত্তি তুলেছেন ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বিকাশমান এই শিল্প এখনই নিয়ন্ত্রিত হলে সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ।
গত সপ্তাহে ই-কমার্স ব্যবসার নানান দিক নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে বসেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র, আইন ও তথ্যমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে বিফ্রিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আইন করা হবে।
তবে তার এই বক্তব্যের তিন দিন পর দোদুল্যমান ভূমিকায় অবতীর্ণ হন টিপু মুনশি। গত রোববার এক কর্মশালায় বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে আইন না নীতিমালা- কী হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। সব দিক পর্যালোচনার পরই নেয়া হবে সিদ্ধান্ত। আইন ও নীতিমালা করার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত এসেছে। এসব পর্যালোচনা করা হচ্ছে।