বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আমি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী: ঝুমন

  •    
  • ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৮:৩৪

ঝুমন বলেন, ‘কেউ স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বললে খারাপ লাগে। এই খারাপ লাগা থেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। এই অধিকার আমার আছে। আমি কোনো ধর্ম নিয়ে তো বলিনি। একজন ব্যক্তির সমালোচনা মানে কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠীর সমালোচনা নয়।’

ফেসবুকে হেফাজতে ইসলামের বিতর্কিত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনার পর প্রায় সাড়ে ছয় মাসের কারাবন্দি জীবন শেষে ঝুমন দাস বলেছেন, তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। নিজের মতপ্রকাশ করা কোনো অপরাধ নয়।

সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত শাল্লা উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ঝুমন। নেই তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।

গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ‘শানে রিসালাত সম্মেলন’ নামে একটি সমাবেশ আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন।

এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ঝুমন দাস। স্ট্যাটাসে তিনি মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন।

মামুনুলের সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা বলে এলাকায় প্রচার চালাতে থাকেন তার অনুসারীরা। এতে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামের লোকজন ১৬ মার্চ রাতে ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

পরদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। তারা ভাঙচুর ও লুটপাট করে ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি, মন্দির। ঝুমনের স্ত্রী সুইটিকে পিটিয়ে আহত করা হয়।

এরপর ২২ মার্চ ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে শাল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল করিম। মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

বারবার আবেদন করেও তিনি জামিন পাচ্ছিলেন না। এ নিয়ে সারা দেশেই ক্ষোভ দেখা দেয়। ঝুমনের জামিনের দাবিতে আন্দোলনেও নামে বিভিন্ন গোষ্ঠী।

কারামুক্তির পর মায়ের সঙ্গে ঝুমন

অবশেষে ২৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ঝুমন। সুনামগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পেয়েছেন মুক্তি।

নিউজবাংলা বুধবার কথা বলেছে ঝুমনের সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা, জেলজীবন ও নাগরিক স্বাধীনতার কথা।

কী অপরাধ ছিল বলে মনে করেন ঝুমন?

ঝুমন বলেন, ‘কী কারণে আমাকে এতদিন জেলে রাখা হলো তা জানি না। আমার অপরাধ কী? আমি আমার মতপ্রকাশ করেছি। কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে লিখিনি। জীবনে কোনো দিনই কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে বলিনি। আমরা এখানে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে চলি।

‘আমি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমাদের পুরো পরিবার স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। আমাদের পরিবারে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন। আমি কোনো দল করি না। তবে আমি স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্বাসী। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বললে খারাপ লাগে। এই খারাপ লাগা থেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। এই অধিকার আমার আছে। আমি কোনো ধর্ম নিয়ে তো বলিনি। একজন ব্যক্তির সমালোচনা মানে কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠীর সমালোচনা নয়।’

আটকের পর যা হয়েছিল

তিনি বলেন, “১৬ মার্চ শাল্লা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমাকে সুনামগঞ্জ শহরের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। পরদিন সন্ধ্যার সময় শাল্লা থানার দুজন পুলিশ সেখান থেকে আমাকে সুনামগঞ্জ আদালতে নিয়ে যান। তারাই বলেন, ‘তোমার গ্রামে তো হামলা হইছে। তোমাদের বাড়িও ভাঙা হইছে।’”

‘এই খবর শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। পরিবারের সদস্যদের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। তবে তখনও ঘটনার ভয়াবহতা পুরোটা আঁচ করতে পারিনি। পরে সমস্ত ঘটনা জানতে পারি’, বলেন ঝুমন।

যেভাবে কেটেছে বন্দিজীবন

হাওরের খোলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা ঝুমনকে প্রায় সাড়ে ছয় মাস কাটাতে হয়েছে জেলখানার চার দেয়ালের মধ্যে।

প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। তারপর সময় কাটানোর জন্য শুরু করেন বই পড়া। কারাগারের লাইব্রেরিতে যে বঙ্গবন্ধু কর্নার আছে, নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে গিয়ে বই পড়তেন। নিজ সেলে এনেও বই পড়ার সুযোগ ছিল। কারাগারের কর্মীরা এ বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করেছেন।

জেল থেকে বের হয়ে ঝুমনের এখন চিন্তা সংসার চালানো নিয়ে। বাড়িতে আছে মা, স্ত্রী ও আট মাস বয়সী ছেলে ঈশান। করোনা আর কারাগার এই দুইয়ে তার ছোট্ট ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে।

ঝুমন বলেন, ‘এখন কী করব, কীভাবে আবার সংসার চালাব তা বুঝে উঠতে পারছি না। তার ওপর আদালতের নির্দেশ আছে, অনুমতি ছাড়া সুনামগঞ্জের বাইরে বের হওয়া যাবে না। আমি আদালতের ওপর আস্থাশীল। তাদের নির্দেশনা মেনে চলব। এসব মেনেই কিছু একটা শুরু করতে হবে।

‘তবে মাত্র তো বের হলাম। এখনও এ নিয়ে কিছু চিন্তা করিনি। কয়েক দিন যাক। তারপর চিন্তা করব।’

জেলজীবনের কষ্ট শেষে বাড়ি ফিরে ঝুমনের তৈরি হয়েছে আরেক মানসিক কষ্ট। দুই মাসের ছেলেকে রেখে যেতে হয়েছিল জেলে। বাড়ি ফিরে ছেলে আর বাবার কোলে যেতে চায় না।

ঝুমন বুঝতে পারেন না, এটা কি ছেলের অভিমান নাকি সে বাবাকে চিনতে পারে না।

নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলে থাকাকালীন ছেলের জন্য খুব খারাপ লাগত। সব সময় মায়ের কথা মনে পড়ত। স্ত্রী, ভাইবোনদের জন্য মন পুড়ত।

‘ছেলেকে কোলে নিতে ইচ্ছা করত খুব। এতদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি আসলাম কিন্তু ছেলে কোলে আসছে না। এ কারণে খুব অশান্তি হচ্ছিল। তবে আজকে সকাল থেকে দেখছি ছেলের অভিমান ভেঙেছে। সকাল থেকে কোলে আসছে, হাসছে।’

ঝুমনের বন্দিজীবনে তার পরিবারের দেখভালের ভার পড়েছিল ভাই নুপুর দাসের ওপর। নুপুর ব্যাংকে কাজ করেন, থাকেন হবিগঞ্জে। কারামুক্ত ভাইকে দেখতে বাড়ি এসেছেন।

তিনি নিউজবাংলাকে জানান, হাইকোর্ট থেকে ঝুমনের জামিন আদেশের পর থেকেই তাদের গ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে।

তবে শঙ্কার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘ঝুমন দাসের জামিন আদেশ পাওয়ার পরপরই তার নিরাপত্তার বিষয়ে এলাকায় খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ নেই। কারামুক্তির পর তাকে ও তার মাকে অফিসে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এরপর তাদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়েছে।

‘আমরা তার খোঁজখবর রাখব। ঝুমন দাস সবার মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন। কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর