বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চায়ে নীরব বিপ্লব

  •    
  • ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১০:৫৯

এখন শুধু মৌলভীবাজার, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ নয়, উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলাতেও হচ্ছে চায়ের চাষ। সারা দেশে সুবিধাজনক মাটিতে চাষের চাষ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চা বোর্ড। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ কোটি কেজি; আর রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ কোটি কেজি।

আগস্ট মাসে দেশে ১ কোটি ৪০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এক মাসে এত চা এর আগে কখনোই উৎপাদন হয়নি।

চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে পানীয়র উৎপাদন। দেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করে এখন রপ্তানিও হচ্ছে। মাঝে রপ্তানিতে নিম্নমুখী ধারা দেখা গেলেও এখন ফের বাড়ছে; আরও বাড়াতে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা ঘোষণা করেছে সরকার। কোনো রপ্তানিকারক ১০০ টাকার চা রপ্তানি করলে সরকারের কোষাগার থেকে তাকে ৪ টাকা দেয়া হবে।

২০২৫ সালের মধ্যে দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ কোটি কেজি; আর রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১ কোটি কেজি।

২০২০ সালে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল দেশে। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছিল ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি। চলতি ২০২১ সালের আট মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে ৫ কোটি ২১ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। রপ্তানি হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি।

২০ বছর আগে ২০০১ সালে ৫ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। তখন দেশে মোট চাহিদা ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার টন। দুই দশকে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ; চাহিদা বেড়েছে তিন গুণের মতো।

এভাবে চা উৎপাদনে বিপ্লব হয়েছে দেশে। এখন শুধু মৌলভীবাজার, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ নয়, উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলাতেও হচ্ছে চায়ের চাষ। সারা দেশে সুবিধাজনক মাটিতে চায়ের চাষ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চা বোর্ড; গবেষণা করছে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট।

চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. জহিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের সব চা-বাগানের সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। উৎপাদনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চা নিলাম কেন্দ্র চালু রাখা, সঠিক সময়ে ভর্তুকি মূল্যে সার বিতরণ, চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, রেশন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করায় গত আগস্ট মাসে চা উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আশা করছি, আগামী দিনগুলোতেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১৪ কোটি কেজি চা উৎপাদনের যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি, তা পূরণ হবে। ১ কোটি কেজি চা রপ্তানির মাইলফলকও অর্জন করা সম্ভব হবে।’

৫৫ শতাংশই উৎপাদন হয় মৌলভীবাজারে

দেশে উৎপাদিত চায়ের বড় অংশ আসে মৌলভীবাজার জেলার বাগানগুলো থেকে। মোট উৎপাদিত চায়ের ৫৫ শতাংশ উৎপাদন হয় এই জেলায়। এরপর আছে হবিগঞ্জ জেলা, যেখানে উৎপাদিত হয় ২২ শতাংশ। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গে ১০ শতাংশ, সিলেট জেলায় ৭ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ৬ শতাংশ উৎপাদন হয়।

চা-বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম বলেন, ‘চায়ের উৎপাদন নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদন ভালো হয়; প্রতিকূল থাকলে কম হয়।

‘তবে, দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। চা বোর্ড কাজ করছে, চা গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চা উৎপাদন শুরু হয়েছে। এসব কারণে চায়ের উৎপাদন এখন বাড়তেই থাকবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি থেকেও মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে।’

রপ্তানি ফের বাড়ছে

দেশে চায়ের চাহিদা বাড়তে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি কমছিল। কমতে কমতে ২০১৯ সালে ৬ লাখ কেজিতে নেমে আসে। ২০২০ সালে আবার বাড়তে শুরু করে রপ্তানি। রপ্তানিকারকেরা গত বছর ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি চা রপ্তানি করেছে। এ থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। গত দুই দশকে চা থেকে রপ্তানি আয় সবচেয়ে বেশি ছিল ২০০৮ সালে; ৮৪ লাখ কেজি থেকে ৯৭ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় হয়েছিল।

তবে, পরিমাণের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি চা রপ্তানি হয়েছিল ২০০২ সালে। ওই বছরে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়। দেশে এসেছিল ৯৪ কোটি টাকা। তার আগের বছরে ২০০১ সালে ৮৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা আয় হয়েছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার কেজি রপ্তানি করে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের দাম এবং যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দামের ওপর নির্ভর করে প্রকৃত রপ্তানি আয়ের হিসাব।

সমতল জমি থেকে আসছে ১০ শতাংশ

বাংলাদেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকায় উৎপাদনও বেড়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ২০০১ সালে দেশে ৫ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল; চাহিদা ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি। চাহিদা মেটানোর পর ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার কেজি রপ্তানি করে ৯০ কোটি টাকা আয় হয়েছিল।

২০১৯ সালে সেই চায়ের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজি হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে হয় ৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। ওই বছরে ৬ লাখ কেজি চা রপ্তানি করে আয় হয় ১৯ কোটি ৪২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ২০২০ সালে উৎপাদন খানিকটা কমে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজিতে নেমে আসে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কত ছিল, তার হিসাব এখনও প্রকাশ করেনি চা বোর্ড। তবে, রপ্তানি এক লাফে সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ২১ লাখ ৭০ হাজার কেজি ওঠে; আয় বেড়ে হয় ৩৪ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

চলতি ২০২১ সালের আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) ৫ কোটি ২১ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে দেশে। এর মধ্যে আগস্ট মাসেই হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ কেজি। রপ্তানি হয়েছে ৩ লাখ ৯০ লাখ কেজি; আয় হয়েছে ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি বাড়াতে ২০২৫ সাল নাগাদ চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ কোটি কেজি নির্ধারণ করেছে সরকার।

সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ও চাহিদা মেটাতে পাহাড়ি উঁচু জমির পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সমতল জমিতেও চা চাষ হচ্ছে; যা চায়ের মোট চাহিদার ১০ শতাংশের বেশি পূরণ করছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।

উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড় জেলায় ১৯৯৬ সালে প্রথম চা চাষের বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। এরপর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। তার ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়।

শুরু ১৮৫৪ সালে

ব্রিটিশ ভারতের বাংলাদেশ অংশে প্রথম বাণিজ্যিকভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানে ১৮৫৪ সালে। সেই সময় থেকে চায়ের রপ্তানি হতো।

বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা-বাগান ও টি এস্টেট রয়েছে বলে জানিয়েছে চা বোর্ড। এর মধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১২৯টি বাগান ও টি এস্টেট।

চা-বাগান করতে গেলে ন্যূনতম ২৫ একর জমি লাগে। অন্য দিকে এস্টেট হলো চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও শ্রমিক-কর্মচারীর মৌলিক সুযোগ সুবিধাসহ চা-বাগান।

সে হিসাবে বাংলাদেশে ২ লাখ ৮০ হাজার একর জমিতে নিবন্ধিত বাগানে চা চাষ হচ্ছে। তবে অনিবন্ধিত, ক্ষুদ্র পরিসরের বাগান এর দ্বিগুণ বলে জানিয়েছেন চা সংশ্লিষ্টরা।

সমতল ভূমিতে চা চাষ

পাহাড়ি এলাকায় এত বছর চা চাষ হয়ে এলেও ২০০০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জেলায় ছোট ছোট বাগানে সেরা মানের চা চাষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

সমতল ভূমিতে উৎপাদিত এই চা বাংলাদেশে চায়ের মোট চাহিদা পূরণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে জানান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘চায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য আমরা সমতলকে বেছে নিয়েছি। এ জন্য আমরা ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় চা চাষের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও কেউ ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষ করতে চাইলে আমরা উদ্বুদ্ধ করছি। সারা দেশে চা চাষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করছি আমরা।’

চাষিদের চা চাষের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মাটি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে সেগুলো চা চাষের উপযোগী কি না। যেসব ভূমি উপযুক্ত নয়, সেগুলো উপযোগী করে তুলতে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান জহিরুল ইসলাম।

উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) আটটি গবেষণা বিভাগ এবং তিনটি উপকেন্দ্রের মাধ্যমে গবেষণা এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। পাঁচটি কর্মসূচির মাধ্যমে বিটিআরআইর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি কর্মসূচি এলাকায় এক বা তারও অধিক গবেষণা বিভাগ কর্মসূচি সম্পাদন করে থাকে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এবং রপ্তানি বাড়াতে উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করেন চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ আলী।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘উচ্চ ফলনশীল জাতের মাধ্যমে প্রতি হেক্টরে চায়ের উৎপাদন বাড়তে হবে। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি; গবেষণা করছি।’

সত্তরের দশকে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৭৩৫ কেজি চা উৎপাদন হতো। সেই উৎপাদন বেড়ে এখন জমিভেদে প্রতি একরে ১৫০০ থেকে ৩৫০০ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।

এ ধরনের উচ্চফলনশীল জাত বের করে উপযুক্ত মাটিতে চাষাবাদ শুরু করা প্রয়োজন বলে জানান মোহাম্মদ আলী। এ ছাড়া পোকামাকড়, আগাছা দমন, সেই সঙ্গে অতিবৃষ্টির মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা উন্নত করার তাগিদ দেন তিনি।

নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যে পাঁচ মাস শুষ্ক মৌসুম, এই সময়ে চায়ের ফলন ঠিক রাখতে খরাসহিষ্ণু চায়ের দুটি জাত উদ্ভাবন করেছে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এই উচ্চফলনশীল ও খরাসহিষ্ণু জাতগুলো চাষিদের কাছে দ্রুত বিতরণ করা গেলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে জানান তিনি।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অতিবৃষ্টি সহনশীল জাত উদ্ভাবনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানান মোহাম্মদ আলী।

এখন আর আমদানি করতে হয় না

এক দশক আগেও ছিল শঙ্কা। রপ্তানি তো হবেই না, উল্টো চায়ের বড় আমদানিকারক দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাতে প্রতিবছর হাতছাড়া হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

এখন সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বড় আমদানিকারক দেশ তো হয়নি, উল্টো রপ্তানিতে দিচ্ছে সুখবর।

উৎপাদন দিয়ে চাহিদা না মেটায় ২০০৯ সালে চা আমদানি শুরু হয়। সর্বোচ্চ আমদানির রেকর্ড ছিল ২০১৫ সালে; মোট ৯৩ লাখ কেজি।

চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন চা আমদানি হয় না বললেই চলে। খুবই ভালো মানের বেশি দামি কিছু আমদানি হয়; যেগুলো অভিজাত লোকজন কিনে থাকেন।’

চায়ে এই সুদিনের নেপথ্যে আছে এক দশক ধরে চা বোর্ড ও উদ্যোক্তাদের নানা উদ্যোগ। এক দশক আগে চা বোর্ড উৎপাদন বাড়ানোর কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে। উদ্যোক্তারা শত বছরের পুরোনো বাগানগুলো সংস্কার করেন। পুরোনো-পরিত্যক্ত বাগান চা চাষের আওতায় আনা হয়। সমতল ভূমিতে চা চাষ সম্প্রসারণ হয় এ সময়। বাজারে ভালো দাম থাকায় চা চাষে মনোযোগী হন উদ্যোক্তারা। তাতেই এই সুফল এসেছে বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।

চা উৎপাদন ও রপ্তানিতে অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ফিনলের পরিচালক এ কিউ আই চৌধুরী বলেন, ‘চা এখন আর আমদানিনির্ভর নয়। দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ হচ্ছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন যত বেশি বাড়বে, রপ্তানির সম্ভাবনাও তত বাড়বে।’

প্রায় ৫২ বছর ধরে চা-শিল্পের সঙ্গে জড়িত এ কিউ আই চৌধুরীর বলেন, ‘উৎপাদনের মতো রপ্তানিতেও ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। সরকার চা রপ্তানিতে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তার যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে রপ্তানি বাড়বে। এটি খুবই ভালো একটি সিদ্ধান্ত।’

সুদিন ফিরেছে

বাংলাদেশে চায়ের সুদিন ধরা হয় নব্বই দশককে। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’র ১৯৮৩ সালের বার্ষিক বুলেটিনে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে চা রপ্তানির প্রথম বছরেই বিশ্ববাজারে এ দেশের অবস্থান ছিল নবম অবস্থানে। রপ্তানি আয়ের হিসাবে ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে ষষ্ঠ অবস্থানে উন্নীত হয়। এখন পঞ্চম অবস্থানে থাকা ভিয়েতনাম তখন ছিল ১৮তম।

রপ্তানির পরিমাণের হিসাবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চা রপ্তানি হয় ১৯৮২ সালে। সে বছর ৩ কোটি ৪৪ লাখ কেজি চা রপ্তানি করে ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় হয়। তখন দেশে চা উৎপাদন হয় ৪ কোটি ৯ লাখ কেজি। এখন উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। দেশে চাহিদা বেশি বাড়ায় অবশ্য তখনকার মতো রপ্তানি হচ্ছে না।

সে সময় এক কোটি কেজি উৎপাদন বাড়াতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১১-১২ বছর। এখন এক বছরেই কোটি কেজি উৎপাদন বাড়ে।

বাংলাদেশ চা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহ মঈনুদ্দীন হাসান বলেন, ‘উদ্যোক্তা ও চা বোর্ডের সম্মিলিত চেষ্টার সুফল এখন দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে চা খাতে। একসময় মনে হচ্ছিল, অন্যান্য পণ্যের মতো চা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হবে। কিন্তু এখন সুদিন ফিরেছে। উৎপাদন বাড়ছে; রপ্তানি বাড়ছে।’

বেশি দামের চা

উৎপাদনে রেকর্ড হচ্ছে, রপ্তানি বাড়ছে। এতেই থেমে থাকতে চান না উদ্যোক্তারা। কালো চায়ের বাইরে সবুজ চা উৎপাদন বাড়িয়েছেন তারা। আবার হোয়াইট টি বা সাদা চা, মসলা চায়ের মতো বহুমুখী পণ্য এনেছেন উদ্যোক্তারা।

ফিনলে, পেডরোলো, কাজী অ্যান্ড কাজীর মতো গ্রুপ নতুন নতুন চা উৎপাদনে নজর দিয়েছে। হালদা ভ্যালির মতো একসময় পরিত্যক্ত বাগানে এখন উৎপাদন হচ্ছে হোয়াইট টি, যেটি সাধারণ চায়ের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি দামি।

হালদা ভ্যালির মালিকানায় থাকা পেডরোলো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান বলেন, সাধারণ মানের চায়ের চেয়ে সবুজ চা, সাদা চায়ের মূল্য অনেক বেশি। বৈশ্বিক বাজারে চাহিদাও ভালো। সে জন্য হালদা ভ্যালি বাগানে উচ্চ মূল্যের চা তৈরির আওতা বাড়ানো হচ্ছে।

বিশ্ববাজার

২০১৮ সালে বিশ্বে চায়ের বাজারের আকার ছিল ২৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সারা বিশ্বে রপ্তানি হয়েছে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের চা। রপ্তানির বাজারের দুই-তৃতীয়াংশ চীন, ভারত, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কার দখলে। পঞ্চম অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। বিশ্বের ৩৫টি দেশে চা উৎপাদন হয়। এ তথ্য গবেষণা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ইনডেক্সবক্সের।

বাংলাদেশে চা রপ্তানি থেকে আয় এখনও খুবই কম। রপ্তানি আয় বাড়াতে চায়ের পণ্যে বহুমুখীকরণের (সুগন্ধি ও ওষুধশিল্পে ব্যবহার) ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফিনলের পরিচালক এ কিউ আই চৌধুরী বলেন, ‘চায়ের বৈচিত্র্য বাড়ানো গেলে রপ্তানি বাজার আরও ভালোভাবে দখল করা সম্ভব।’

এ বিভাগের আরো খবর