উত্থান পতনের পুঁজিবাজারে টানা দুই দিন বাড়ল সূচক। আগের দিন ১৪ পয়েন্টের পর এবার বাড়ল ৪৫ পয়েন্ট। সূচকের পাশাপাশি লেনদেন আবার দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
গত জুলাই থেকে সূচক এক হাজার ২৬০ পয়েন্টের বেশি উত্থানের পর চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যে দর সংশোধন শুরু হয়েছে, মঙ্গলবারের লেনদেন স্বস্তির আভাস দিল কি না, তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শুরু হয়েছে আলোচনা।
গত অর্থবছরে দারুণ লভ্যাংশের পর চলতি বছর আরও ভালো করার আভাস দেয়া ব্যাংক খাতের ঘুরে দাঁড়ানো দিনের লেনদেনের প্রধান ঘটনা হিসেবেই ধরা যায়। বহুদিন পর দর বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষ ১০ তালিকায় কোনো ব্যাংকের অবস্থান দেখা গেল।
এই খাতের কোম্পানিগুলোর সিংহভাগের দর বৃদ্ধির মধ্যে বৃদ্ধির হারটাও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তির কারণ। ৩ থেকে ৪ শতাংশ দর বেড়েছে অনেকগুলো ব্যাংকের।
অস্বাভাবিক দর বাড়া স্বল্প মূলধনি ও লোকসানি কোম্পানির দর পতন অব্যাহত আছে। সবচেয়ে বেশি দর হারানো ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৯টিই এই ধরনের কোম্পানি। যদিও দর পতনের হার শতকরা হিসেবে খুব একটা বেশি নয়।
সূচকে প্রায় ৫০ পয়েন্ট যোগ হলেও দরপতন হয়েছে বেশিরভাগ শেয়ারের। ১৬৪টি শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ১৭২টির দর। আর অপরিবর্তিত ছিল ৩৯টির দর।
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
আগের দিন লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে গেলেও তা আবার বেড়ে দুই হাজার একশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
সূচক বাড়ার পেছনে যে ১০টি কোম্পানি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, সেগুলো হলো আইসিবি, লাফার্জ হোলসিম, ওয়ালটন, সাবমেরিন কোম্পানি, পাওয়ার গ্রিড, আইএফআইসি ব্যাংক, শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানি ব্র্যাক ব্যাংক ও সামিট পাওয়ার।
এই ১০টি কোম্পানিই সূচকে যোগ করেছে ৩০.১৪ পয়েন্ট।
অন্যদিকে যে ১০টি কোম্পানির কারণ সূচক কমেছে সবচেয়ে বেশি, সেগুলো হলো গ্রামীণ ফোন, ইবিএল, বার্জার পেইন্টস, বেক্সিমকো ফার্মা, রবি, কোহিনূর, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, মুন্নু সিরামিকস, জেনারেশন নেক্সট ও কেয়া কসমেটিকস।
এই কোম্পানিগুলোর কারণে সূচক পড়েছে ৯.০৯ পয়েন্ট।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকের উত্থান ও পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা ১০টি করে কোম্পানি
স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেশি পড়লেও সেগুলোর শেয়ার সংখ্যা কম থাকায় সূচকে প্রভাব পড়ে কম। আর জেড ক্যাটাগরির লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর যাই হোক না কেন, তার প্রভাব একেবারেই পড়ে না সূচকে।
খাতওয়ারি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোম্পানির দর বৃদ্ধির হিসাব করলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শেয়ারের দর বেড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে বেশিরভাগের দাম বাড়লেও দাম বৃদ্ধির হার একেবারেই নগণ্য। মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে বিমা, বস্ত্র, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে।
আর লেনদেনের দিন থেকে আবারও এগিয়ে ওষুধ ও রসায়ন খাত। দ্বিতীয় অবস্থানে প্রকৌশল খাত। যদিও এই দুটি খাতের বেশিরভাগ কোম্পানি শেয়ারদর হারিয়েছে।
স্বল্প মূলধনির পতন
তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে পতনের মধ্যে থাকা স্বল্প মূলধনি ও লোকসানি কোম্পানিগুলো দর হারাল আরও খানিকটা।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে মুন্নু গ্রুপের দুই কোম্পানি। ২০১৯ সালে কারসাজি করে শেয়ারদর বাড়ানোর ঘটনায় তাদেরকে করা ১৫ কোটি টাকা জরিমানা বহাল রেখে বিএসইসির সিদ্ধান্তের সংবাদ গণমাধ্যমে আসে সোমবার।
পরদিন মূলধনি মুন্নু সিরামিকের দর ৫.১২ শতাংশ আর মুন্নু অ্যাগ্রোর দর কমেছে ৪.১০ শতাংশ।
এ ছাড়া বন্ধ কোম্পানি তুংহাই ৪.০৫ শতাংশ, স্বল্প মূলধনি কোহিনূর কেমিক্যাল ৩.৭২ শতাংশ, সিভিও পেট্রো ক্যামিকেল ৩.৫৫ শতাংশ, রহিম টেক্সটাইল ৩.৪১ শতাংশ, লোকসানি খুলনা পেপার ও বন্ধ মিথুন নিটিং ৩.০৬ শতাংশ করে, লোকসানি মেঘনা পেট ৩ শতাংশ, লোকসানি জাহিন স্পিনিং ২.৬৭ শতাংশ দর হারিয়েছে।
লেনদেনের রাজত্ব ওষুধ ও বস্ত্রে
ধারবাহিকভাবে লেনদেনে রাজত্ব ধরে রেখেছে ওষুধ ও রসায়ন খাত। মঙ্গলবার অন্য যে কোনো খাতের তুলনায় এ দুই খাতের সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে।
২৬ সেপ্টেম্বর ওষুধ ও রসায়ন খাতে মোট লেনদেন হয়েছিল ৩৬৮ কোটি টাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর লেনদেন কিছুটা কমে ২৮৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় নেমে আসলেও অন্য যে কোনো খাতের তুলনায় বেশি লেনদেন হয়েছিল এ খাতে। মঙ্গলবারও একইভাবে লেনদেনের শীর্ষে ছিল, লেনদেন হয়েছে মোট ৩১৫ কোটি ৯ লাখ টাকা।
তবে লেনদেনে আগ্রহ থাকলেও এই খাতের বেশিরভাগ কোম্পানি দর হারিয়েছে। ৯টি কোম্পানির দর বাড়ার বিপরীতে কমেছে ২১টির। একটির লেনদেন ছিল স্থগিত।
মঙ্গলবার ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে এই পাঁচ খাতে
এই খাতের কোম্পানিগুলোর দর বৃদ্ধির হার শতকরা হিসেবে খুব একটা বেশি ছিল না। সবচেয়ে বেশি ৩.১৮ শতাংশ দর বেড়েছে এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেকের শেয়ার।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩.০৯ শতাংশ দর বেড়েছে বিকন ফার্মার। এ ছাড়া অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের দর ২.৬৮ শতাংশ, ওরিয়ন ফার্মার দর ২.৪৫ শতাংশ বেড়েছে।
লেনদেনে দ্বিতী অবস্থানে থাকা বস্ত্র খাতে হাতবদল হয়েছে ২৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার। আগের দিন লেনদেন ছিল ২২৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
এ খাতের মোট ২৮টি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে, কমেছে ২৩টির, অপরিবর্তিত ছিল বাকি ৭টির দর।
বস্ত্র খাতের সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে প্যাসিফিক ডেনিমের; ৭.৮৬ শতাংশ। তারপরই আছে সায়হাম টেক্সটাইল যার দর বেড়েছে ৭.৬৫ শতাংশ। এছাড়া ইটিএলের দর ৭.০৯ শতাংশ এবং দেশ গার্মেন্টসের ৬.৭৬ শতাংশ, সিমটেক্সের দর ৬.৪২ শতাংশ বেড়েছে।
এ খাতের সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে তুং হাই নিটিংয়ের ৪.০৪ শতাংশ। রহিম টেক্সটাইলের শেয়ার দর কমেছে ৩.৪১ শতাংশ।
ব্যাংক-বিমায় স্বস্তি
টানা তৃতীয় সপ্তাহ ধরে ব্যাংক খাতে হতাশার পর অবশেষে খানিকটা আশার আলো দেখা গেছে। ৩২টি শেয়ারের মধ্যে ২৪টির দাম বেড়েছে, কমেছে ৩টির দর, একটির লেনদেন ছিল স্থগিত আর অপরিবর্তিত ছিল বাকি চারটির দর।
এতদিন দেখা গেছে, শেয়ারদর যেগুলোর বেড়েছে, শতকরা হিসেবে ছিল একেবারেই নগণ্য। সেই বৃত্তও ভেঙেছে কিছুটা।
লেনদেনেও উন্নতি হয়েছে। হাতবদল হয়েছে মোট ১১৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১০৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।
সবচেয়ে বেশি ৬.০৮ শতাংশ বেড়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের দর। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের দর বেড়েছে ৪.৫১ শতাংশ। এছাড়া এবি ব্যাংকের ৩.৩৩ শতাংশ, এনবিএলের দর ২.৪১ শতাংশ বেড়েছে।
দীর্ঘদিন পর ব্যাংক খাতে একটি ভালো দিন দেখা গেছে
ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি দর কমেছে ইস্টার্ন ব্যাংকের ১.৭৩ শতাংশ।
বিমা খাতেও লেনদেন বেড়েছে। হাতবদল হয়েছে ১৭৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকার শেয়ার। আগের দিন লেনদেন ছিল ১৬২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এই খাতে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের ৬.১১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রূপালী ইন্স্যুরেন্সের দর বেড়েছে ৫.৪৭ শতাংশ। এ ছাড়া পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের দর ৩.৯৩ শতাংশ ও ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের দর ১.৪৭ শতাংশ বেড়েছে।
এই খাতে সবচেয়ে বেশি ২.৪৫ শতাংশ দর হারিয়েছে গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ২.৩৭ শতাংশ।
ঊর্ধ্বমুখী থেকে পতনে প্রকৌশল
সোমবার এই খাতে ১৩ টি কোম্পানির দর পতনের বিপরীতে বাড়ে ২৮টির, অপরিবর্তিত ছিল একটির দর। লেনদেন হয়েছিল ২৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা।
একদিন পর এই খাতে ২৩টি কোম্পানির শেয়ার দর হারিয়েছে। বাড়ে ১৭টির দর। দুটির দর ছিল অপরিবর্তিত। লেনদেন হয়েছে মোট ২৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
এ খাতের সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে দেশবন্ধু পলিমার। কোম্পানির শেয়ার দিনের সর্বোচ্চ ৮.৬৮ শতাংশ বেড়েছে। তারপরই ছিল এস আলম কোল্ডরিচের দর দর বেড়েছে ৩.৮২ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে মুন্নু এগ্রো অ্যান্ড জেনারেল মেশিনারিজ ৪.১০ শতাংশ। ডমিনেজ স্টিলের দর কমেছে ৩.৭২ শতাংশ।
অন্যান্য খাতের লেনদেন
প্রধান অন্যান্য খাতগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দরপতনের সঙ্গে লেনদেন ও কমেছে।
এই খাতে হাতবদল হয়েছে ২০৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ১৪৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
২৩টি কোম্পানির মধ্যে ১১টির দর বেড়েছে, ৯টির কমেছে আর তিনটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
আর্থিক খাতে লেনদেন হয়েছে ১৬৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৭১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ খাতের ১৫ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর বেড়েছে, কমেছে ৪টির, তিনটির দর ছিল অপরিবর্তিত আর একটির লেনদেন ছিল স্থগিত।
বিবিধ খাতের ১৪টি লেনদেন হয়েছে ১৩৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৮২ কোটি ৯ লাখ টাকা।
এই খাতে ১৪টি কোম্পানির মধ্যে তিনটির দর বেড়েছে। দশটির দর কমেছে। একটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
কোম্পানিগুলোর মধ্যে এক বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে দশমিক ১৪ শতাংশ।
খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ২০টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৭টির, কমেছে ১৩টির।
লেনদেন হয়েছে ৪৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৬০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে ইউনিটগুলোর মধ্যে ৮টি ফান্ডের দর কমেছে, ১৪ টির দর বেড়েছে আর বাকি ১৪টির দর আগের দিনের মতোই আছে।
হাতবদল হয়েছে ১৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৪৫ দশমিক ৫২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২৯৭ পয়েন্টে।
শরিয়াভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ৬ দশমিক ৫১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৮৫ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ১৫ দশমিক ৫৭ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৯১ পয়েন্টে।
দিনশেষে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ১৩৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আগরে দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এক দিনে লেনদেন বেড়েছে ১৫৫ কোটি টাকা।
চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই ১৮৬ দশমিক ৪৫ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩৩৪ দশমিক ৭৫ পয়েন্টে।
৩১৯টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৬৭টির, কমেছে ১১২৬টির ও পাল্টায়নি ২৬টির।
লেনদেন হয়েছে ৬৭ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৭৯ কোটি টাকা।