আসছে অক্টোবরের প্রথম দিকেই চালু হতে যাচ্ছে বরিশালের পায়রা সেতু। এরপরই বন্ধ হয়ে যাবে এই অঞ্চলের সবশেষ ফেরিঘাট-লেবুখালি ঘাট।
সেতু চালু হলে সাগরকন্যা কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দর যেতে যাত্রীদের ভোগান্তি একেবারেই কমে যাবে। তা নিঃসন্দেহে খুশির কথা। তবে, ফেরিঘাট বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে ঘাট সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা কর্মহীন হয়ে পরার আশঙ্কায় রয়েছেন। সাধারণ মানুষ অবশ্য তাতে আনন্দিতই। তারা বলছেন, ঘাটের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ‘উৎপাতও’ বন্ধ হবে।
লেবুখালি ফেরিঘাটের বরিশালের পারে ভাতের হোটেল চালান মোহাম্মদ ইব্রাহিম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘১৫-২০ বছর ধইরা এই ঘাটে হোটেল ব্যবসা করতে আছি। অনেক বছরের স্মৃতি। ফেরি বন্ধ হইয়া গেলে অনেক কষ্ট হইবে।
‘আমার বাড়ি বাকেরগঞ্জের রঙ্গশ্রীতে। এহন মূলত আমি ভাবতে আছি কী করমু ফেরি বন্ধ হইয়া গেলে। এলাকায় যাইয়া ভাতের হোটেল দেয়ার কথাই ভাবতে আছি, কিন্তু হেডা আমার জন্য জমাইতে কষ্ট হইয়া যাইবে। অন্য কামে যাওয়ার কথাও ভাবতে আছি। কী করমু এহনও ফাইনাল কিছু করিনাই। তয় কষ্ট হইলেও এই পায়রা নদী উপর যে সেতুটা হইছে, দেখতেও ভালো লাগে অনেক।’
সবুজ ইসলাম নামে এক চা দোকানি বলেন, ‘কর্ম সংকটে পড়তে হইবে আমার। এই ঘাটের উপর নির্ভর কইরা ৭ সদস্যর সংসার আমার চালাইন্না লাগে। ফেরি না চললে কইতে গেলে পথে যাইয়া পড়মু।
‘অনেক বছর এহানে। কত স্মৃতি কাটাইছে। অনেক গ্যাঞ্জাম দিয়া মানুষরে বাঁচাইছি। সেতু চালু হইলে ভালো লাগবে একদিক দিয়া, আবার আরেক দিক দিয়া অনেক খারাপ লাগবে। কেমনে কী চলমু বুঝি না।’
ফেরিঘাটে ঘুরে ঘুরে চিড়াভাজা বিক্রি করেন সামছুল আলম। প্রায় ১৬ বছর ধরে এই কাজে আছেন তিনি। জানালেন, ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে পটুয়াখালী শহরে চলে যাবেন বিকল্প কাজের খোঁজে। কিছু না হলে সেখানেও চিড়া বিক্রি করবেন।
ব্যবসা বন্ধের দুঃখ তো আছেই, সেইসঙ্গে স্মৃতিকাতরতাও যোগ হয়েছে ইউসুফ মিঞার।
তিনি বলেন, ‘৬-৭ বছর ধইরা ব্যবসা করি এইহানে। খারাপ তো লাগতে আছে, এইহান দিয়া চইলা যাওয়া লাগবে। মানুষের ভিড় আর দেখতে পারমু না। কত গল্প, কত কেচ্ছা আর যে কুয়াকাটা যাওয়ার সময় মানুষের আনন্দ দেখতে পারমু না। এহন তো আর ফেরিঘাটে দাঁড়াইয়া গল্পও করবে না। ডায়রেক্ট সেতুতে উইঠা চইলা যাইবে।
‘সেতু উদ্বোধনের লগে লগেই আমাগো ব্যবসা শেষ। এইটা সেতুর কাম ধরার লগে লগেই চিন্তা কইরা রাখছি কী করমু। বাকেরগঞ্জ শহরেই বাসা মোর। চইলা যামু, এলাকায় যাইয়া দোকান দিমু। তয় ভালো লাগতে আছে একটা দিক দিয়া যে মানুষের ভোগান্তি থাকবে না।’
ষাটোর্ধ্ব জগলুল হায়দার এই ঘাটে প্রায় ২০ বছর ধরে বাদাম বিক্রি করেন। ফেরি বন্ধের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অশ্রুসজল চোখি তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে অনেক ঝামেলা দেখছি ঘাটে, পারলে যাইয়া ছাড়াইয়া দিছি। মিথ্যা কথা কইয়া লাভ কী, কিছু লোকজন এই ঘাটে মানুষজনরে কম মারে নাই। কিছু হইলেই মারামারি করা লাগতো।
‘আর এইটা বড় হইতো ঘাটের দোহানদারগো লইগ্গা। হেরাও শাহেন শাহর নাহান মানুষজনরে মারতো। সবাই না, তয় কিছু দোহানদার এইডা সব সময় করতো। দোহান পাইত্তা মানুষজনের ধার দিয়া জোড় কইরা টাহা রাহারও ঘটনা আছে। তয় ওসব কথা কইয়া কি হইবে, সেতু চালু হইয়া গেলে সব কিছুই ইতিহাস হইয়া যাইবে।’
তবে ঘাট বন্ধ সুসংবাদ এই পথের যাত্রীদের জন্য।
পিরোজপুরের স্বরুপকাঠির ব্যবসায়ি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসায়িক কাজে পটুয়াখালীর কলাপাড়া প্রায়ই যেতে হয় আমাকে। পর্যটকদের কীভাবে হেনস্থা করেছে এই লেবুখালি ঘাটের লোকজন সেটা নিজ চোখে দেখা। বহুবার মারামারি দেখেছি।
‘আর সেটা শুরু হতো কখনও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে, আবার কখনো ঘাটের দোকানদারদের সঙ্গে। যার সঙ্গেই শুরু হোক, সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধলেই হলো, সবাই এক হয়ে মারধর। ব্যাপক নির্যাতন করা হতো। সেই নির্যাতন থেকে বাঁচতে পারবে দক্ষিণাঞ্চলবাসী ও কুয়াকাটাকার পর্যটকরাও।’
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১৫ সেপ্টেম্বর এক ভার্চুয়াল সভায় জানিয়েছেন, বরিশালের লেবুখালির পায়রা সেতু দিয়ে অক্টোবরেই যান চলাচল করতে পারবে।
পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল হালিম জানান, পায়রা সেতু নির্মাণে নদীর তলদেশে বসানো হয়েছে ১৩০ মিটার দীর্ঘ পাইল, যা দেশে সর্ববৃহৎ। ৩২টি স্প্যানের মূল সেতুটি বিভিন্ন মাপের ৫৫টি টেস্ট পাইলসহ দশটি পিয়ার, পাইল ও পিয়ার ক্যাপের ওপর নির্মিত। এ ছাড়া ১৬৭টি বক্স গার্ডার সেগমেন্ট রয়েছে এটিতে। যার ফলে দূর থেকে সেতুটিকে মনে হবে ঝুলে আছে।
এই সেতু চালু হলে বরিশাল থেকে বাসে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগবে মাত্র আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেলে আরও দ্রুত যাওয়া যাবে এই পর্যটন স্পটে।