কুড়িগ্রামের ৯ উপজেলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতার টাকা পাচ্ছেন না ৭ হাজারের বেশি সুবিধাভোগী। বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী এসব মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদ কিংবা বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকে তাদের অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা যায়নি। ছয় মাস থেকে শুরু করে অনেকে ১৯ মাস পর্যন্ত ভাতার টাকা পাননি।
অভিযোগ উঠেছে, মাঠকর্মীদের অবহেলায় অনেকের বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্ট নম্বর ভুল হয়েছে। অনেকে সঠিক নম্বর দেয়ার পরও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কর্মীরা ভুল নম্বর তুলেছেন।
আবার অসাধু একটি চক্র অন্য নম্বর দিয়ে টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে আসছে সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ। তবে এত দিনেও নম্বর ঠিক করা যায়নি কেন এবং পাঠানো ভাতার টাকা কাদের কাছে যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক সুবিধাভোগী।
কুড়িগ্রাম সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জেলার ৯ উপজেলায় বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাগ্রহীতার সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ৬০৫ জন। তাদের মধ্যে মোবাইল নম্বরে ত্রুটিজনিত কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছেন না ৭ হাজার ১০৭ জন।
এর মধ্যে সদরে ৩৬৬ জন, নাগেশ্বরীতে ২৯, ভূরুঙ্গামারীতে ১ হাজার ১৭৩, ফুলবাড়ীতে ২ হাজার ৩৮২, রাজারহাটে ৩৫২, উলিপুরে ৭২৯, চিলমারীতে ১১৯, রৌমারীতে ১ হাজার ৪২৩ এবং রাজিবপুরে ৫৩৪ জন রয়েছেন।
সরকার প্রতি মাসে এসব ভাতাভোগীর মধ্যে বয়স্ক ও বিধবাদের ৫০০ টাকা এবং প্রতিবন্ধীদের ৭৫০ টাকা করে দেয়।
সুবিধাভোগীরা জানান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতার টাকা এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি সুবিধাভোগীর বিকাশ বা নগদ নম্বরে পাঠায় সরকার। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদাসীনতায় ভাতাভোগীদের মোবাইল নম্বর ভুল এন্ট্রি করায় তাদের অনেকে দীর্ঘদিন ধরে টাকা পাচ্ছেন না।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে অনেকে জানতে পারেন, তাদের ভাতার টাকা চলে গেছে অন্যের মোবাইল নম্বরে। তবে সেই মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
অনলাইন পদ্ধতি চালুর পর একটি অসাধুচক্র নানা কৌশলে দরিদ্র মানুষের ভাতার টাকা আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ তাদের।
ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা গ্রামের বাসিন্দা অটোচালক সুশীল চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমার মা সুশিলা রাণীর বয়স্ক ভাতা হয়েছে। তবে দুইবারের ৬ হাজার টাকা আমার মা পায়নি। উপজেলা সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করে দেখি, আমার মায়ের দেয়া নম্বরের জায়গায় অন্যজনের মোবাইল নম্বর দেয়া। অফিস থেকে আমাকে বলল, থানায় জিডি করেন। আমি আর সে ঝামেলায় যাইনি।’
কুড়িগ্রামে অনেকের ভাতার টাকা ভুল নম্বরে পাঠানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ছবি: নিউজবাংলা
একই এলাকার গঙ্গা রাণী বলেন, ‘অফিস মোবাইল নম্বর-টম্বর ঠিক করলং, এলাও টাকা পাই নাই। ওমরা কয় পাইবেন- এই পর্যন্ত।’
একই ইউনিয়নের শরলিধরা গ্রামের সামেদুল হক বলেন, ‘মোবাইলত টাকা দেয়া শুরু করছে থাকি মেলা মাইসে সেই টাকা পায় নাই। এই যে করোনার মধ্যে বয়স্ক, বিধবা ভাতা না পাইয়া অভাব-অটনের মধ্যে দিন কাটাইলেও এলাও টাকা পাই নাই।’
সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের চর সাবডোব বাসিন্দা আহম্মদ আলী জানান, তার মায়ের বয়স্ক ভাতার জন্য জাতীয় পরিচয় নম্বর ও মোবাইল নম্বর নির্ভুল দিয়েছেন। সেখানে কর্মকর্তার স্বাক্ষরও আছে।
অথচ বয়স্ক ভাতার টাকা দুবার না পাওয়ায় তিনি অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখেন অন্য নম্বরে টাকা গেছে। সেই নম্বরে ফোন দিলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
সব তথ্য ঠিকমতো দেয়া হলেও অসাধুচক্রের কারণে তার মা ভাতার টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন আহম্মদ আলী।
হলোখানা গ্রামের জাহেরা বেগম বলেন, ‘আমার বিধবা ভাতা হইছে। আইডি কার্ড, মোবাইল নম্বর স্পষ্ট করে লিখে দিছি। এলা টাকা পাই না।
‘অফিসত খোঁজ নিয়া দেখি, আমি দিছি গ্রামীণ নম্বর বিকাশ করার জন্য আর টাকা যায় রবি নম্বরে। সেই নম্বর বন্ধ থাকে, ফোন দিলেও যায় না। এলা হামার এত দিনের টাকা অন্য মানুষ খাইল, তার বিচার কাই করবে?’
বলদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘একটি কুচক্রী মহলের কারণে আমার ইউনিয়নে ছয় শর ওপর মানুষ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা ১৯ মাস থেকে পাচ্ছে না। এত দিন থেকে এই কুচক্রী মহল টাকাগুলো তুললেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।'
আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে টাকা ফেরতের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাতার কাজ ৪-৫ ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। কেউ একটু ভুল করলেই সেই ভাতাভোগী বঞ্চিত হচ্ছেন। এ জন্য সুবিধাভোগীর আঙুলের ছাপ বা চোখের ছাপ নিলে এই সমস্যা আর হবে না।’
প্রকৃত ভাতাভোগীরা টাকা না পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক রোকোনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কিছু অসাধু এজেন্টের কারণে টাকা ভুল নম্বরে গেলেও এর সঙ্গে সমাজসেবার কেউ জড়িত নয়। গ্রামের মানুষের মোবাইল সম্পর্কে ততটা জ্ঞান না থাকায় মোবাইল এজেন্টের কাছে বা অন্য কারও কাছে গিয়ে নিজেদের পিন কোড বলে দেয়। ফলে অসাধুচক্রটি কৌশলে সেই টাকা উত্তোলন করে থাকে।’
ভাতাভোগীদের এনআইডি ও মোবাইল নম্বরের পাশাপাশি তাদের আঙুল কিংবা চোখের কর্নিয়ার স্ক্যান নিয়ে টাকা বিতরণ করা হলে এই জটিলতা হতো না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।