মেয়র জাহাঙ্গীরকে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে গাজীপুর আওয়ামীলীগের বড় একটি অংশ। মধ্যরাতে নিজ বাসায় বসে জাহাঙ্গীরের কথোপকথনের একটি ভিডিও ফেসবুকে ফাঁস হওয়াকে কেন্দ্র করে রোববার এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
এদিনও জাহাঙ্গীরের বিচার দাবিতে গাজীপুরে বিক্ষোভ হয়েছে। এ নিয়ে টানা পঞ্চম দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন গাজীপুরের ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধও করেন তারা। অবরোধের কারণে টঙ্গী-কালিগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কে হঠাৎ থমকে যায় গাড়ির চাকা। প্রভাব পড়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও। দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা।
রোববার বিকেল ৪টায় টঙ্গীর শিলমুন ও টিএন্ডটি বাজার এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে ৪৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এতে ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সদস্য সচিব আহসান উল্লাহ, মহানগর তাঁতীলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আমান, ওয়ার্ড যুবলীগের আহবায়ক মনির হোসেন সাগর, ছাত্রলীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন সুজনসহ কয়েকশ নেতাকর্মী অংশ নেন। এ সময় টিএন্ডটি বাজার এলাকায় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রায় এক ঘন্টা টঙ্গী-কালীগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়।
একই সময়ে ৫৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের আহবায়ক আলী আফজাল খান দুলুর নেতৃত্বে আরও একটি বিক্ষোভ মিছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে নতুন বাজার দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হয়। এতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের যুগ্ন আহবায়ক কামরুজ্জামান জামান, এনতাজ মোড়ল, হাজী কাশেম সরকার, ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি সফিকুল ইসলাম স্বপন, যুবলীগ নেতা সেতু সরকার, রুমি সরকার, রাসেল, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান পিংকু প্রমুখ।
বিক্ষোভকারীদের অবরোধে বন্ধ হয়ে যায় সড়কে যান চলাচল
জাহাঙ্গীরকে বর্জনের ঘোষণা
বিগত বিক্ষোভ সমাবেশে সরাসরি কোনো সমালোচনা না করলেও রোববার মেয়র জাহাঙ্গীরের তীব্র সমালোচনা করেছেন মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খানসহ এক ডজন নেতা।
২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন ও পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগ জনসভা করবে। ওই জনসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র জাহাঙ্গীরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ওই জনসভায় মেয়র বিরোধীরা ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। আর এ জন্যই রোববার সন্ধ্যায় টঙ্গী থানা আওয়মীলীগের দলীয় কার্যালয়ে এক প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই মেয়রের সমালোচনায় সরব হন আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মেয়র জাহাঙ্গীরের পদত্যাগ ও বিচার দাবি করেন তারা।
সভায় মহানগর তাঁতীলীগের সভাপতি শাহ আলম জাহাঙ্গীরের কড়া সমালোচনা করে বলেন, ‘গাজীপুরের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারকে নিয়ে সমালোচনা করে মেয়র জাহাঙ্গীর লাই পেয়েছে। লাই পাওয়ার কারণে সে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সমালোচনা করার সাহস পেয়েছে। তার জিহ্বা লম্বা হয়ে গেছে, সেই জিহ্বা এখনই কেটে দিতে হবে। জামাত-বিএনপির সঙ্গে গোপন বৈঠক করতে করতে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বিপক্ষে বলে ফেলে।’
টঙ্গী সরকারী কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি কাজী মঞ্জুর বলেন, ‘ব্যক্তি জাহাঙ্গীর বা মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আমাদের কোন আক্রোশ নেই। আমরা সবাই মুজিব আদর্শের সন্তান। জাহাঙ্গীর আলম বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ন্যাক্করজনক যে বক্তব্য দিয়েছেন তার জন্য অবশ্যই তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। নয়তো টঙ্গী সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ সহিংস কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।’
৫৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের যুগ্ম আহবায়ক সেলিম হোসেন মেয়র জাহাঙ্গীরকে নাবালক উল্লেখ করে বলেন, ‘নাবালক একটি ছেলে এসে মাত্র সোয়া তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর নৌকাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। সেই নৌকাটি সংস্কার করবে আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। আমরা যেন সবাই মিলে একটি নৌকায় উঠে আমাদের গন্তব্যে যেতে পারি।’
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটুক্তির কারণে মেয়র জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার ও মেয়র পদ থেকে পদত্যাগেরও দাবি জানান সেলিম।
সভায় মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘মেয়র জাহাঙ্গীর শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি কটুক্তি করেননি, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, চেতনার প্রতি সে কটুক্তি করেছেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে ৬৪টি জেলায় ৪৫ হাজার করে লোক মারা গেছে। অত্যন্ত সুচতুরভাবে তিনি এই গাণিতিক হিসেবটি দিয়েছেন। ৩০ লক্ষ শহীদকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এই হিসেবটি তার একটি প্রমাণ। খালেদা জিয়া বলেছেন, ত্রিশ লক্ষ লোক মারা যায় নাই, আর সে একটা গাণিতিক হিসেব দিয়ে দেখিয়ে দিল ২৮ লক্ষ ৮০ হাজার লোক মারা গেছে। সুতরাং এটা স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের আওয়াজের প্রতিধ্বনি।’
আজমত বলেন, ‘ইতোমধ্যে মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি হিসেবে আমি স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রতি কটাক্ষ যিনি করবেন তার সাথে রাজনৈতিক কোন সম্পর্ক তো নয়ই, কোন সামাজিক সম্পর্কও রাখা যাবেনা।’
তিনি জানান, গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি দেশের বাইরে অবস্থান করেও তার নির্বাচনী এলাকায় একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকার নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দিয়েছেন, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তার কোন মিছিল মিটিংয়ে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা যাবেনা।
আজমত বলেন, ‘আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যে কথা বিএনপি জামাত বলতে পারে নাই, এই ধরণের বক্তব্য জাহাঙ্গীর দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে আসার পর এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।’
আজমত উল্লাহ নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আমাদের মনে যে দুঃখ, সেই দুঃখের বহিঃপ্রকাশ একদিন করে, দুইদিন করে বন্ধ রাখলে চলবে না। এটা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।’
২৮ তারিখের জনসভায় তাই গণজোয়ার সৃষ্টির আহবান জানান তিনি।
প্রস্তুতি সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন- মহানগর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি, সহ-সভাপতি ওসমান আলী খান, কোষাধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদিন, টঙ্গী থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফজলুল হক, অধ্যক্ষ জাহিদ আল মামুন, ৫১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামীলীগের সদস্য আব্দুল আলিম মোল্লা, শ্রমিক নেতা মতিউর রহমান বিকম, ৪৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম নুরু, কৃষকলীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন হেলাল, ৫৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন মোল্লা, ৫০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী আবু বক্কর সিদ্দিক, মহানগর যুবলীগ নেতা বিল্লাল হোসেন মোল্লাসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।